নির্যাতিত-নিপীরত, শোষিত-অনুন্নত, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ, সামাজিকভাবে অবহেলিত, দরিদ্র-অর্থক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে তার ছিলো গভীর সম্পর্ক। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারত বাংলা প্রদেশের সাধারণ আসন বরিশালের বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের পূর্ব-উত্তর এলাকায় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রথম এমএলএ। অবিভক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রী, ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সরকারের আইন ও শ্রম মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। তিনিই প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেছেন।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মৈস্তারকান্দি গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে নিজেকে উৎস্বর্গ করে দেয়ায় তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে “মহাপ্রান”র খেতাবে ভূষিত করেছেন। এ মহাপ্রান ব্যক্তির ১১৬ তম জন্মজয়ন্তী উৎসব আজ ২৯ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে গৌরনদীর মৈস্তারকান্দি গ্রামের “মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদ”র উদ্যোগে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মহৎ কাজের জন্য যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তাইতো তিনি তার একটি বাণীতে লিখেছিলেন-“যদি আজ কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারে যে, আমার জীবনের বিনিময়ে আট কোটি তফসিলীর সার্বভৌম মুক্তি আসিবে। তবে আমি সে মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করিতে পারিবো। যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে অথবা জলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাঙ্খা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।”
মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের ইতিহাস ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ জানান, ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মৈস্তারকান্দি গ্রামের কৃষক রাম দয়াল মন্ডল ও সন্ধ্যা দেবীর ঘর আলোকিত করে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জন্মগ্রহন করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে তার বাল্য শিক্ষার জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেনীতে বার্থী তাঁরা ইনষ্টিটিউশনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রবেশিকা (মেট্রিকুলেশন) পাশ করেন। ওই বছরেই বরিশাল বিএম কলেজে আইএ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ এবং ১৯২৯ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কোলকাতা আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে প্রথমে কোলকাতায় এবং একই বছর বরিশালে আইনজীবী হিসেবে তিনি যোগদান করেন।
১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের আইনসভার একটি মাত্র সাধারণ আসনে তফসিলী জাতির একমাত্র প্রার্থী হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হন। এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পূর্ণরায় এমএলএ নির্বাচিত হয়ে সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেন। শেষভাগে অবিভক্ত ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছিলো গভীর সম্পর্ক। সবশেষে সোহয়ারর্দীর অনেক অনুরোধের পর ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী সভার আইন ও শ্রম মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই (যোগেন্দ্রনাথ) প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৫০ সালে দেশের রায়ট শেষে তিনি (যোগেন্দ্রনাথ) রায়ট উপদ্রত্য অঞ্চল পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তিনি তার স্ব-জাতি, অনুন্নত জনসাধারনের জানমাল ও অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতা প্রকাশ করে রাজধানী করাচীতে ফিরে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। কিন্তু তার এ পদত্যাগের বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি হননি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। একপর্যায়ে বীরের বেশে পাকিস্তান থেকে রেলযোগে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ভারতে ফিরে তিনি আট পৃষ্টায় কারণ উল্লেখ্য করে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরন করেন। তৎকালীন সময়ে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় এ রির্পোটটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে শরনার্থীদের কল্যানে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।
১৯৬৮ সালে ভারতের চব্বিশ পরগনার স্ব-জাতি বন্ধুর বাড়িতে খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পরেন তিনি। তড়িঘড়ি করে ভারতে ফেরার পথিমধ্যে মহাপ্রনয়ন ঘটে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের। চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা এলাকায় সমাহিত করা হয় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে। তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে (যোগেন্দ্রনাথকে) মহাপ্রানের খেতাব ভূষিত করেন।
মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের অন্যতম সদস্য ডাঃ মনোতোষ সরকার বলেন, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের একমাত্র পুত্র জগদ্বীশ মন্ডল (৮৯) পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতেই বসবাস করছেন। মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথের জন্মভূমিতে এখন তার পৌত্রদ্বয় (নাতীরা) বসবাস করছেন। যোগেন্দ্রনাথের বড়ভাই মহানন্দ মন্ডলের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ, তার পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ মন্ডল ওরফে ঝন্টু ও প্রদ্বীপ কুমার মন্ডল ওরফে মন্টু তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মৈস্তারকান্দি গ্রামে বসবাস করছেন। দিনমজুরের কাজ করেই চলছে ঝন্টু ও মন্টুর সংসার। তিনি আরও জানান, জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় সেবা আশ্রম প্রাঙ্গনে আজ ২৯ জানুয়ারি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের প্রতিকৃতিতে পূস্পার্ঘ অর্পন ও মাল্যদান, শ্রীমদভগবত গীতা পাঠ, দুপুরে ভক্তি গীতির অনুষ্ঠান, মহাপ্রান যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের জিবনী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের ওপর আলোচনা সভা এবং কবি গান।
স্থানীয় মনোজ কুমার গোমস্তা, লক্ষি কান্ত বৈদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা শামসুল হক সরদারসহ অনেকেই জানান, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এতদাঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কর্মস্থলের সুযোগ করে দিয়েছেন সহস্রাধীক বেকার-যুবকদের। এছাড়াও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশ্ববর্তী বেজগাতি-বাশাইল ভায়া মৈস্তারকান্দির জনগুরুতপূর্ণ খালটি খনন করা হয়েছে যোগেন্দ্রনাথের সময়েই। গ্রামবাসী মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্মৃতিবিজরীত জন্মস্থান মৈস্তারকান্দি গ্রামে মহাপ্রানের নামানুসারে স্মৃতিজাদুঘর, পাঠাগার, গবেষনা কেন্দ্র ও একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।