১৯৭৫ থেকে ২০২০। ঘাতকদের বুলেটের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে ৪৫ বছর কাটিয়ে দেয়া শহীদ জননী সাহান আরা বেগম চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
রবিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হলেও দুখের এ খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শোকের ছায়া নেসে আসে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
ঢাকায় প্রথম এবং বরিশালে নিয়ে এসে দ্বিতীয় দফা জানাযা শেষে রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় তাঁকে বগুড়া রোড মুসলিম গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃতিও শোক পালন করছে। আকাশে নেই সূর্য। মেঘলা আকাশ। অঝোর ধারায় ঝড়ে বৃষ্টিও যেন শোক প্রকাশ করছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে সাহান আরা বেগমের শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু ঘাতকতের বুলেটে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হয়। সেদিন বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও আরেক শিশু পুত্র, আজকের বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে কোনভাবে প্রানে বেঁচে গিয়েছিলেন সাহান আরা ।
সেদিনকার কালো রাতের নিমর্ম বর্বরতার ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ জননী সাহান আরা বেগম গত রোববার রাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
জননী সাহসিকা সাহান আরা তাঁর দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণে বড় বড় বির্পযয়ের সময়ে ভেঙে পড়েননি। তিনি সকল বিপদ যেমন শক্ত হাতে সামলিয়েছেন তেমনি স্বামী, সন্তানকে ভালবাসার বাঁধনে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন ভরসার আশ্রয়স্থল।
৪ সন্তানের জননী সাহান আরা একজন ভালো গৃহীনি ও যেমন একজন ভালো মা ছিলেন তেমনি পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনও ছিলেন। স্বামী পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহবায়ক, মন্ত্রী ও বরিশাল-১ আসনের সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে তিনি সবসময় তাঁর সকল কাজে সমর্থন ও সাহস জুগিয়েছেন।
৯৬ পরবর্তী সময়ে তাঁকেও স্বামী সন্তানকে নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করতে হয়েছে। কোনভাবেই মনোবল না হারিয়ে সকলকে নিয়ে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে রেখে ছিলেন সেই ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে জীবদ্দশায় তিনি প্রতিষ্ঠিত দেখে গেছেন।
সন্তান মেয়র হওয়ার পর একবারের জন্য তিনি ছেলের অফিস কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। মাকে নিজের চেয়ারে বসিয়ে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ সেদিন কতোটাযে আনন্দিত হয়েছিলেন তা যারা চোখে দেখেননি তারা হয়তো অনুধাবনও করতে পারবেন না।
দলের দুঃসময়ে সাহান আরা দলীয় নেতাকর্মীদের অভিভাবকের ন্যায় সাহস জুগিয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার পাশাপাশি মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সাহান আরা রাজনীতিতে যেমন যুক্ত ছিলেন তেমনি ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তিনি বরিশালের অন্যতম নাট্য সংগঠন শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের উপদেষ্টা মন্ডলীর চেয়ারম্যান ছিলেন। যুক্ত ছিলেন প্রান্তিকের সাথেও।
গান প্রেমী সাহান আরা দর্শকদের অনুরোধে মাঝে মাঝে গান গাইতেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শব্দাবলীতে তিনি গান গেয়েছিলেন। সাহান আরা বেগম একজন সমাজসেবী ছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে সহায়তা পাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সাহান আরা বেগম দৈনিক আজকের পরিবর্তন ও মাসিক আনন্দ লিখনের সাথে যুক্ত থেকে এ দুটি পত্রিকা প্রকাশে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন দীর্ঘদিন। সাহান আরা বেগমকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন তারা জানেন তিনি কতোটা আলাপি আর স্পষ্টবাদী ছিলেন।
একজন নারী হয়েও তিনি অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। তিনি প্রায়শই বলতেন ৭৫ সালেই মরে যেতে পারতাম। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাহস জুগিয়েছেন সবসময়। বোধ করি তাঁর অনুপ্রেরণাতেই বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ রাজনীতিতে বেশী সক্রিয় হয়েছিলেন।
সাদিক আবদুল্লাহ তাঁর মা-বাবাকে কতোখানি ভক্তি শ্রদ্ধা করেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মায়ের পায়ের তলাতে সন্তানের জান্নাত এটা মনে প্রানে বিশ্বাস করে সাদিক আবদুল্লাহ তাঁর সকল ভালো কাজে মা-বাবার পায়ে সালাম দিতে ভুলেন না।
তাঁর মমতাময়ী মায়ের আকস্মিক চলে যাওয়ায় তিনি দারুনভাবে ব্যথিত হয়েছেন। এই শোক কাটিয়ে উঠতে তাঁর অনেক সময় লাগবে। যে মায়ের কারণে পৃথিবীর মুখ দেখা, যার বিচক্ষণতার কারণে নতুন জীবন পাওয়া সেই মায়ের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর জন্য কতোটা বেদনার তা কেউ-ই বুঝবেনা। মহান আল্লাহতালা শোকাহত এ পরিবারকে শোক বইবার শক্তি দান করুন।