রাজধানীর উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের নার্সরা ভালো নেই। জীবন বাজি রেখে ভ’য়াবহ ছোঁয়াচে ক’রোনাভা’ইরাসেে আ’ক্রান্ত রো’গীদের সেবায় দিনরাত নিয়োজিত থাকলেও প্রতিটি মুহূর্ত সংক্রমিত হওয়ার অজানা আ’তঙ্ক তাড়া করছে তাদের। হাসপাতালটিতে ভর্তি রো’গীর সংখ্যার তুলনায় নার্স সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে বা’ধ্য হওয়ায় অ’সুস্থ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের। টানা সাতদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার কথা থাকলেও নার্স সং’কটের কারণে এ সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) জুটলেও ‘এন-৯৫’ মাস্কের নামে যে মাস্ক দেয়া হয়েছে তা পরিধান করে ডিউটি করতে ভ’য় পাচ্ছেন তারা।
শুধু তাই নয়, হাড়ভাঙা খাটুনির পর নার্সদের সুষম খাদ্যগ্রহণ অত্যাবশ্যক হলেও তাদের ভাগ্যে জুটছে স্থানীয় একটি হোটেলের রান্না করা নিম্নমানের খাবার। তদুপরি বাজেট না থাকার কারণে গতকাল (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নার্সদের না খেয়ে কা’টাতে হয়েছে। ক’রোনা আ’ক্রান্ত রো’গীদের সরাসরি সংস্পর্শে আসার কারণে তারা স্বাভাবিক সময়ের মতো ডিউটি শেষ করে পরিবার-পরিজনের কাছে বাসায় ফিরে সময় কা’টাতে পারছেন না। হাসপাতালে ডিউটি শেষে তাদের উত্তরার একটি আবাসিক হোটেলে থাকতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে কর্তব্যরত ৮৭ জন নার্সের অনেকেই শা’রীরিক ও মা’নসিকভাবে ভে’ঙে পড়েছেন। এতদিন মুখ না খুললেও গতকাল হঠাৎ করে বাজেট নেই- এ দোহাই দিয়ে খাবার বন্ধ করে দেয়ার পর তাদের ‘বোবাকা’ন্না’ কিছুটা হলেও সরব হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ক’রোনা রো’গীদের সেবায় নিয়োজিত কয়েকজন নার্স এর সঙ্গে আলাপকালে তাদের দুঃখ-ক’ষ্টের কথা তুলে ধরেন। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, এ হাসপাতালটির তৃতীয় তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত বর্তমানে ১৩০ জন ক’রোনা রো’গী ভর্তি রয়েছেন। এ হাসপাতালটিতে স্থায়ী ও ডেপুটেশন মিলিয়ে বর্তমানে নার্সের সংখ্যা ৮৭ জন। তাদের মধ্যে ৩০ জন নার্স ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিউউ) ডিউটি করেন। বাকি ৫৭ জনের মধ্যে ৭-৮ জন মাতৃকালীন ছুটি, গর্ভবতী ও সিনিয়র নার্স থাকায় প্রকৃতপক্ষে কমবেশি ৪৫ জন নার্সকে ওয়ার্ডে রো’গী সামলানোসহ দাফতরিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। নার্সের সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ও রো’গীদের সংস্পর্শে বেশি বেশি আসতে হচ্ছে। তারা বলেন, আইসিইউ ছাড়াই ওয়ার্ড ও অন্যান্য ওয়ার্কিং স্টেশন সামলাতে প্রতি শিফটে কমপক্ষে ৩৫ জন নার্স অর্থাৎ তিন শিফটে শতাধিক নার্স নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
নার্সরা জানান, বৈশ্বিক ম’হামা’রি ও জাতির এ দু’র্যোগকালে তারা পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে জীবন বাজি রেখে ক’রোনা রো’গীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকতে রাজি আছেন কিন্তু এভাবে অতিরিক্ত কাজের চা’পের কারণে তারা শা’রীরিক ও মা’নসিকভাবে বি’পর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও নার্সিং অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের যোগদানের সময় জানিয়েছিলেন, ক’রোনা রো’গীদের চিকিৎসাসেবায় সাতদিন ডিউটি করার পর তারা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে যাবেন। কিন্তু তাদের অনেকেরই ৯-১০ দিন হয়ে গেলেও ডিউটি করতে বা’ধ্য করা হচ্ছে। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ক’রোনা রো’গীদের চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজনীয় আইসিইউসহ সকল ধরনের যন্ত্রপাতি, ও’ষুধপত্র ও পিপিই সরবরাহ রয়েছে বলে তারা জানান। তবে এন-৯৫ মাস্ক বলে যে মাস্কটি সরবরাহ করা হয়েছে তা নিম্নমানের উল্লেখ করে তারা বলেন, এটি যে সুরক্ষা দেবে না তা দেখেই বোঝা যায়। ফলে প্রতিনিয়ত সংক্রমিত হওয়ার ভ’য়ে থাকেন তারা। একাধিক নার্স জানান, তারা যখন ওয়ার্ডে ডিউটিতে যান তখন ওয়ানটাইম পিপিই পরে যান। সেখানে ডিউটি শেষে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে ব্যবহৃত সব কিছু ধ্বং’স করে গোসল করে তবেই জরুরি বিভাগ বা অন্যত্র আসেন। সেখানেও তারা পিপিই পরেই থাকেন। সে পিপিইর মান ভালো শুধুমাত্র এন-৯৫ মাস্ক ছাড়া।
কোথায় থাকছেন, কী খাচ্ছেন নার্সরা
জানা গেছে, ক’রোনাভা’ইরাসেে আ’ক্রান্ত রো’গীদের চিকিৎসাসেবার সাথে জ’ড়িত থাকার কারণে নার্সদের অধিকাংশই বাসায় থাকছেন না। হাসপাতালের অদূরেই স’রকারিভাবে একটি আবাসিক হোটেল ভাড়া করে সেখানে আনুমানিক ৬০ জন নার্স, টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টকে রাখা হচ্ছে। হোটেল কর্তৃপক্ষই তাদের তিন বেলার খাবার সরবরাহ করে থাকে। নার্সরা জানান, হোটেলের খাবার নিম্নমানের। তদুপরি বাজেট না থাকার সুবাদে গতকাল তাদের অনেককেই অভুক্ত থাকতে হয়েছে। সকালে ভাত আর ডাল রান্না হলেও অধিকাংশের ভাগ্যেই তা জোটেনি। তারা জানান, হাসপাতালে যারা ডিউটিতে থাকেন তারা ওয়ার্ডবয় পাঠিয়ে হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খান। কিন্তু গতকাল হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, স’রকারিভাবে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে তারা খাবার সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন। বিক্ষু’ব্ধ নার্সরা বি’ষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতর ও নার্সিং অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানালে তারা আন্তরিকতার সাথে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালান। দুপুরে তারা কিছু টাকা পাঠিয়ে আপাতত ফলমূল কিনে খেতে বলেন। নার্স নেতাদের কয়েকজনও সেখানে সহকর্মীদের জন্য ফলমূল কিনে নিয়ে যান। সারাদিন অভুক্ত থাকলেও রাতের বেলায় তাদের জন্য বিরিয়ানি পাঠানো হয়। মিডিয়ায় প্রচারের ফলে অভুক্ত থাকতে হয়নি বলে মনে করেন কয়েকজন নার্স।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ও স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপকালে রাজধানীসহ সারাদেশে ক’রোনা আ’ক্রান্ত রো’গীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত নার্সদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জো’র দাবি জানিয়ে বলেন, ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে তাদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে ক’রোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি কিংবা রো’গী বৃ’দ্ধি পেলে নার্সের আরও সং’কট দেখা দেবে। স্বানাপ মহাস’চিব ইকবাল হোসেন সবুজ বলেন, স্বানাপসহ নার্সদের শীর্ষ সংগঠনের নেতাদের নার্সিং অধিদফতরের মনিটরিং টিমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নার্সিং অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে মনিটরিং ও সমন্বয় কমিটি গঠিত হলেও রাজধানীসহ সারাদেশের নার্সদের সঙ্গে ওই কর্মকর্তাদের যোগাযোগ নেই। স্বাস্থ্য ম’ন্ত্রণালয়ের কমিটিতে ডাক্তারদের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য যেমন বিএমএ ও স্বাচিপ নেতাদের কমিটিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ঠিক তেমনি নার্সদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে নার্স নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।