মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ ,পিরোজপুর প্রতিনিধি।
সুন্দরবন—বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢাল ও জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাণ্ডার। এই বন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং উপকূলীয় জনপদকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার এক অদৃশ্য প্রাচীর। কিন্তু এই অমূল্য বন রক্ষার দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, সেই বনকর্মীরা আজ ন্যূনতম মানবিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। তাদের অন্যতম মৌলিক সংকট—রেশন সুবিধার অভাব।
যেখানে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, সেখানে খাদ্য নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই বাস্তবতা থেকেই প্রশ্ন উঠছে—
“যাদের কপালে হাট-বাজারই জোটে না, তারা কেন রেশন সুবিধা পাবেন না?”
জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালনঃ
সুন্দরবনে কর্মরত বনরক্ষী, বন প্রহরী, বিট কর্মকর্তা, নৌচালক ও অন্যান্য মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের দীর্ঘ সময় বনের গভীরে অবস্থান করতে হয়। কখনো ৭ দিন, কখনো ১০–১৫ দিন পর্যন্ত তাঁদের থাকতে হয় দুর্গম বনরক্ষী স্টেশন বা চৌকিতে। এই সময়টাতে নেই কোনো বাজার, নেই খাবার সংগ্রহের স্বাভাবিক সুযোগ।

তাদের প্রতিদিনের কর্মজীবন ঘিরে থাকে নানামুখী ঝুঁকি—
>> বাঘের হামলায় প্রতিবছরই প্রাণহানির ঘটনা
>> জলদস্যু ও চোরাশিকারিদের সশস্ত্র হুমকি
>> ঝড়-বৃষ্টি, নদীর আকস্মিক স্রোত ও নৌদুর্ঘটনার আশঙ্কা
>> পরিবার থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা
এই চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করা কর্মীদের জন্য রেশন সুবিধা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং প্রাথমিক মানবিক অধিকার।
হাট-বাজার নেই, তবু রেশনও নেইঃ
সুন্দরবনের গভীরে দায়িত্ব পালন করতে গেলে কর্মীদের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী আগেভাগেই বহন করে নিতে হয়। চাল, ডাল, লবণ, তেল—সবকিছু নিজেদের খরচে সংগ্রহ করে নিতে হয়। অনেক সময় তা পর্যাপ্ত হয় না, আবার আবহাওয়া খারাপ হলে নৌযোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়।

বনরক্ষীর কণ্ঠে শোনা যায় হতাশা—
“আমরা যখন বনে ঢুকি, তখন বাজারের কথা ভুলেই যাই। খাবার শেষ হয়ে গেলে উপায় থাকে না। রেশন থাকলে অন্তত দায়িত্বে মনোযোগ দেওয়া যেত।”
অন্যান্য বাহিনী রেশন পায়, বনকর্মীরা নয়ঃ
বাংলাদেশে পুলিশ, আনসার, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী নিয়মিত রেশন সুবিধা পেয়ে থাকে। অথচ সুন্দরবনের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা—
দুর্গম এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন
>> বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি হন
>> চোরাশিকারিদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করেন
>> দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় জীবন ঝুঁকি নেন
তবু তারা আজও রেশন সুবিধার আওতার বাইরে। এটি দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অবহেলা ও নীতিগত অসঙ্গতিরই প্রতিফলন।
করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ডেপুটি রেঞ্জার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, সুন্দরবন ভ্রমণ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে তাতে বাস্তবতা এই—লোকালয় অর্থাৎ বাজার থেকে প্রায় ১৩০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে অফিস। অনেক অফিস আছে সেখান থেকে লোকালয়ে অর্থাৎ বাজারে পৌঁছাতে প্রায় দুই দিন সময় লাগে, এ সময় বনরক্ষীরা বাজার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তাদের যে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনা। তাই আমার অনুরোধ বন রক্ষা,মানসিক বিকাশ ,সর্বোপরি বন্যপ্রাণী ও বন রক্ষার স্বার্থে কমপক্ষে এই দূরবর্তী অফিস সমূহে রেশনিং ব্যবস্থা করা উচিত।

(ডিএফও)রেজাউল করিম চৌধুরীর ফেইজবুক স্ট্যাটাস
পূর্ব সুন্দরবনের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী ফেইসবুক স্ট্যাটাসে হতাশা ব্যক্ত করে লিখেছেন– “আমার মাথায় আসে না যে — কেন সুন্দরবনের বন কর্মচারীগণ রেশন সামগ্রী পাবেন না? যাদের কপালে হাট-বাজারই জোটে না, আবার পরিশ্রম ও ঝুঁকির যেখানে কোনো শেষ নেই!!”
রেশন সুবিধা কেন জরুরিঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের বনকর্মীদের জন্য রেশন চালু হলে—
১.খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে
২.দায়িত্ব পালনে মানসিক চাপ কমবে
৩.কর্মীদের মনোবল ও দক্ষতা বাড়বে
৪.দায়িত্বে শৈথিল্য কমে আসবে
৫.চোরাশিকার দমন কার্যক্রম আরও কার্যকর হবে
৬.আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে মানবিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে
৭.বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে পেশাদারিত্ব বাড়বে

সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের ঐতিহ্য। এই বন রক্ষার দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো যদি অবহেলিত থাকে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে বন সংরক্ষণ কার্যক্রমে।
অতএব সময় এসেছে নীতিনির্ধারকদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সুন্দরবনের সব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত রেশন সুবিধার আওতায় আনা হোক, যাতে তারা জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তাও পায়।
