More

    করোনা: বিভূতি একাই ২৬ দিনে ২১৫ নমুনা সংগ্রহ করলেন

    অবশ্যই পরুন

    বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কাজ শুরু হয় গত ২৯ মার্চ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ বছর বয়সী যুবক ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের টেকনোলজিস্ট বিভূতি ভূষণ হালদার একাই করোনা ভাইরাস সন্দেহভাজনসহ আক্রান্ত রোগীদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। ওই দিন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ২১৫ বার রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি।

    বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া এলাকার সন্তান বিভূতির সাহসিকতামূলক এ কর্মকাণ্ড এরইমধ্যে স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও প্রশংসা কুড়াচ্ছে।

    হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যখন করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন টেকনোলজিস্টসহ অনেকেরই সাহায্য চায় কর্তৃপক্ষ। প্রথমদিকে কয়েকজনকে নিয়ে একটি দলও গঠন করা হয়। তবে রোগীদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে নানানভাবে পিছিয়ে যান সবাই। এরপর কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের টেকনোলজিস্ট বিভূতি ভূষণ হালদারকে এ কাজ করার জন্য ডাক পাঠান।

    প্রথমে কিছুটা শঙ্কিত হলেও মনের ভেতর সাহস সঞ্চার করে মুহূর্তের মধ্যেই নমুনা সংগ্রহের কাজে রাজি হয়ে যান তিনি। এরপর ২৯ মার্চ প্রথম ছয়জনের নমুনা সংগ্রহ দিয়ে শুরু হয় তার এগিয়ে চলা। গেলো ২৬ দিনে বিভিন্ন রোগীর কাছ থেকে ২১৫ বার নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। সবশেষ ২৩ এপ্রিল ২৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এসব নমুনা পরীক্ষা করে বেশ কয়েকজন রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তারপরও দমে যাননি বিভূতি ভূষণ।

    তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘যখন সবাই পিছু হটেছে। তখন বিষয়টি আমি জানতাম না। যেদিন আমাকে ডাকা হলো সেদিন সে সময় আমি হাসপাতালের বাইরে ছিলাম। স্যাররা যখন ডাকলো তখন আমি তাদের কাছে গিয়ে হাজির হই। এরপর আইইডিসিআরে নমুনা পাঠানোর কাজের কথা বললো আমাকে এবং আমি রাজি হওয়ার পর সফটস্টিক-পিপিসহ সব সরঞ্জাম আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। প্রথম দিন ২৯ মার্চ থেকেই বাবা-মা, স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়ায় কাজ শুরু করলাম। যখন এ কাজের দায়িত্ব নিলাম তখন বাবা-মাকে জানিয়েছি। বাবা সুধাংশু হালদার মেডিক্যাল টার্মে চাকরি করতেন বিধায় তিনি যেতে বললেন। মা রঞ্জা রানী হালদার বললেন, যারা অসুস্থ হচ্ছে তারাও তো আমার মতো কোনো না কোন মায়ের সন্তান। আমি সেরকম ভাগ্য নিয়ে আসিনি যে আমার ছেলের কিছু হবে। তুমি ফিরে আসবেই। আর আমিও পরম করুণাময়ের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে কাজে নেমে পড়লাম।’

    বিভূতি বলেন, ‘প্রথম কয়েকদিন একা নমুনা সংগ্রহ করার কাজটি করার পর মনে হলো একজন প্রয়োজন যে আমার সঙ্গে থাকবে। যে আমার কিছু মালামালের বাক্স বহন করবে, শরীরে স্প্রে করে দেবে। তাই স্যারদের বলে সাহায্যকারী হিসেবে অফিস সহায়ক বায়েজিদকে পেলাম। কিন্তু সেও অল্পদিনের মধ্যে অসুস্থ বোধ করলো, তার নমুনা পরীক্ষা করা হলো তবে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হলো না। তারপরও শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় তাকে বিশ্রামে পাঠানো হলো। কিন্তু কাজটি যাতে বন্ধ না হয়ে যায় তাই, সবমালামাল একা আনা-নেয়া করছি, পায়ে হেঁটে হাসপাতালের পশ্চিম প্রান্তে আমার নির্ধারিত কক্ষ থেকে করোনা ওয়ার্ড, হোস্টেলগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে দিচ্ছি। এতে শরীর কিছুটা ব্যথা হলেও মনোবলই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’

    তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বের দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশেও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের মানুষ একটু অন্যভাবে দেখে। এর সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত বলে আমাকেও অনেককিছু ফেস করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না কেউ, দূরে দূরে থাকে সবাই। যদিও সার্বিক নিরাপত্তার কারণে আমাকেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে হয়।’

    বিভূতি ভূষণ হালদার একাই ২৬ দিনে ২১৫ নমুনা সংগ্রহ করলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট বিভূতি বলেন, ‘বাবা-মাকে কতোদিন দেখিন, বাড়িতেও যাইনা কতদিন। তারপরও পরিবারসহ সাধারণ মানুষ সবাই যেন নিরাপদে থাকে তাই নিজেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ন্ত্রণে রাখছি। আগে একটি বেসরকারি এনজিওতে থাকতাম, তখন বাড়ি থেকে খাবার আসতো। আর এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি বেসরকারি হোটেলে আমার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে আসি। কারণ সবাই নিরাপদ থাক।’

    তিনি বলেন, ‘২১৫ বার সংগ্রহ করা নমুনার মধ্যে মাত্র ১৪টি ঢাকায় পাঠানো হয়েছিলো, বাকিগুলো এখানে করা হয়েছে। কারো করোনা শনাক্ত হয়েছে, কারো হয়নি। তবে প্রার্থনা করি খুব তাড়াতাড়ি এ অবস্থার নিরসন ঘটুক, যেন সবাই শান্তিতে বসবাস করতে পারি, আগের মতো আবার যোগাযোগ রাখতে পারি। আর ইচ্ছে আছে যতদিন সুস্থ থাকবো ততদিন নমুনা সংগ্রহের এ কাজ চালিয়ে যাবো। নিজের করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করিনি, কারণ এখন পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখছি না। যদি অসুস্থ হয়েই যাই, তাহলে সুস্থ হয়ে আবার এসে কাজটি চালিয়ে যাবো।’

    রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থেকে পাশ করে ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা বিভূতি বলেন, ‘ইনডোর ও আউটডোর চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা পাশে থেকে সবসময় আমাকে উৎসাহ, সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। আমার সহকর্মী ও বন্ধুরা সবসময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, সাহস দিচ্ছে।’

    হাসপাতালের স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক লিংকন দত্ত বলেন, ‘আমি করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালণকালে বিভূতিকে দেখেছি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে। তাকে আমরা স্যালুট জানাই তার সাহসিকতার জন্য, তার কাজের জন্য।’

    বিভূতির মতো যুবকদেরই সত্যিকারের নায়ক হিসেবে দেখছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেনসহ অন্য চিকিৎসকরা।

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    ইতিহাসে প্রথম একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট

    আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২০২৬ সালের...