ঈদুল আজহার পর একক দলকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তবে সেই আন্দোলন হবে নতুন মাত্রার। দলের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, দাবি আদায়ে কয়েক মাস ধরে যে ধরনের কর্মসূচি চলছিল, চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম পর্বেও একই ধরনের কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি হবে। তবে এটি আরও জোরেশোরে পালিত হবে, আরও শোডাউন সহ। এ সময় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীদের রাজপথে আনতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের আচরণ দেখে দলটি কর্মসূচি পুনর্বিন্যাস করতে পারে। অবশ্য জোরপূর্বক কোনো বিরোধপূর্ণ কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।
জানা গেছে, ঈদের পর একমাত্র আন্দোলনই হবে বিএনপির মূল কেন্দ্র। সে কারণে দল ও অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠন ও পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হবে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এরই মধ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সরকারের অবস্থানও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে দলটি। সরকার আগামী নির্বাচন কীভাবে করতে চায়, তাদের এজেন্ডা কী, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কোনো উদ্যোগ আছে কি না- এসব দিকে নজর রাখছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ ছাড়া আদালত, পুলিশ, প্রশাসনের কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না অর্থাৎ নেতাদের মামলার রায় কেমন হচ্ছে, জামিনে আদালতের অবস্থান কী, পুলিশের ভূমিকা কী। ক্ষেত্রবিশেষে – এগুলোও কর্মকর্তার দ্বারা খুব সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড দেখে দলের কর্মসূচিও পুনর্বিন্যাস করা হবে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারি হামলা-মামলা-গ্রেফতার-নির্যাতন-নির্যাতনের মাত্রা বাড়লে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে দলটি। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে রাজপথ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায় দলটি।
একদলীয় আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালবেলাকে বলেন, একদলীয় আন্দোলনের দাবি সর্বত্র। মূলত ১০ দফার দাবি এক দফায় আসবে। এর কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নেই। একদলের আন্দোলন মানেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যুক্ত হয়েছেন। আশা করছি, আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন হবে।
১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে একযোগে আন্দোলন শুরু করে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। ঈদুল ফিতর পর্যন্ত একযোগে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। সে সময় পর্যন্ত গণমিছিল, গণঅবস্থান, মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিলের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। তবে ঈদের পর থেকে বিএনপি একাই কর্মসূচি পালন করছে। আর বিএনপির কর্মসূচির মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বড় শহরে ১১ দফার ভিত্তিতে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের প্রধান তিনটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ‘যুব সমাবেশ’ করছে। তরুণদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারুণ্যের এই সমাবেশ ১৪ জুন চট্টগ্রামে একটি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। আর ঢাকায় যুবসমাবেশকে ঘিরে সরকারকে বড় ধাক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
এদিকে ঈদুল ফিতরের পর থেকে বিএনপির পাশাপাশি যৌথ দল ও জোটও কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। দলীয় ব্যানারে একযোগে কর্মসূচি পালন করছেন তারা। ঈদের পর জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক পক্ষের যৌথ ঘোষণার পর আবারও মাঠে আন্দোলন করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সরকারবিরোধী সফল আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত কয়েকদিন ধরে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দিতে পুলিশ-প্রশাসনকে অনুরোধ করে আসছে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে দলটির নেতারা বলছেন, জনগণের অধিকার আদায়ে আন্দোলন চলছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটাবেন না।
বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যারা বাধা দিচ্ছেন, তাদের ভিডিওসহ আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের দীর্ঘ তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এ তালিকায় এ পর্যন্ত চার হাজারের বেশি পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। দলটির দাবি, গত ১৪ বছরে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন, নির্যাতন ও গুম মামলায় তারা জড়িত। এর বাইরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপিতে সহায়তা করার সঙ্গেও তাদের অনেকেই জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের তৎকালীন ডিসি, এসপি, অতিরিক্ত এসপি, এএসপি, ওসি, এসআই, যারা বর্তমানে ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএনপি নেতাদের অভিমত, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সংলাপের বিষয়টি সরকার এখন পর্যন্ত নাকচ করে দিলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপে ঈদের পর বিএনপিকে সংলাপে ডাকা হতে পারে। তবে দলটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বা এ ধরনের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপে বসবে না বিএনপি। কারণ, সংলাপ নিয়ে বিএনপির অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তা ছাড়া এজেন্ডা ছাড়া কোনো সংলাপে না যাওয়ার জন্য কেন্দ্রের তরফে তৃণমূলের পক্ষ থেকে অনেক চাপ রয়েছে।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান স্পষ্ট বলে মনে করেন নেতারা। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এরই অংশ হিসেবে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এই অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সেজন্য ভবিষ্যতে তাদের পক্ষ থেকে আরও পদক্ষেপ আসতে পারে। কারণ, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপও তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে দেশে অরাজক পরিবেশ তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। সেক্ষেত্রে যে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার দায়ভার নিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে।