দফায় দফায় তাপ প্রবাহের হাত ধরে নিম্নমানের পথ খাবারে বরিশাল অঞ্চলে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়ার সাথে নতুনকরে ডেঙ্গুও ফিরে আসছে। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ ডায়রিয়া রোগি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছেন। গত দেড়মাসে বরিশালের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১৮ হাজারেরও বেশী ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের পেটের পীড়া নিয়ে প্রায় ৬ হাজার রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত ১ মাসে সংখ্যাটা ছিল প্রায় ১১ হাজার। আর বছরের প্রথম সাড়ে ৪ মাসে প্রায় ৩৮ হাজার নারী পুরুষ ও শিশু ডায়রিয়াসহ নানা পেটের পীড়া নিয়ে বরিশালের সরকারি হাসপাতালে ভর্তিসহ চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এর বাইরে সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসহ বিভিন্ন চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আরো অন্তত ৪গুন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন।
এসময়ে বরিশালের সরকারি হাসপাতালেই দুজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নতুন করে অবনতিশীল হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন হলেও এসব রোগ প্রতিরোধের তেমন কোন সমন্বিত উদ্যোগ নেই। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে নতুন করে ৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী বরিশাল অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের। এ নিয়ে বরিশালে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৪১০ জনে। আর মারা গেছেন ২১৮ জন। গত মাসে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তিকৃত ৫৭ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনেই ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা গত মাসের ৩০ দিনের তুলনায় ১৮ জন বেশী। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার বংশ বিস্তার প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই বলে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বর্ষা শুরুর আগেই এ ব্যাপারে আরো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা। হাসপাতালগুলোতে রোগীর অস্বাভাবিক ভীড়ে সুষ্ঠু চিকিৎসা দুরের কথা অনেক রোগীকে মেঝেতেও স্থান দেয়া যাচ্ছে না। স্যালাইনসহ চিকিৎসা সামগ্রীর অভাব না থাকলেও চিকিৎসক সংকটের সাথে অত্যাধিক রোগীর চাপে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অবশ্য ‘৩৭৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে’ বলে জানান হলেও মঞ্জুরীকৃত চিকিৎসকের অর্ধেকেরও বেশী পদ শূণ্য থাকায় এসব টিমে প্রায় কোনটিতেই চিকিৎসক নেই। তবে দু-তিনটি টিমের জন্য একজন করে চিকিৎসক দায়িত্বে আছেন বলে জানানো হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসেও বরিশাল অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ১২ হাজার ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। তবে ডায়রিয়া ও পেটের পীড়া নিয়ে আরো কয়েকগুন রোগী বিভিন্ন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার এবং বেসরকারি ক্লিনিকসহ রোগীদের বাসায়ই চিকিৎসা নিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের হিসেব এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর আগমনের সংখ্যাটা ছিল সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশী। আর গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ৫১০ জনে। গত বছরও বরিশাল অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৭২ হাজার ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নেন। যে সংখ্যাটা আগের বছর ছিল ৭৭ হাজারেরও বেশী। আর ২০২১-এ করোনা মহামারীর সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও বরিশালে প্রায় ৮০ হাজার ডায়রিয়া রোগী সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য আসেন।
এবার গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই দফায় দফায় তাপ প্রবাহের সাথে ডায়রিয়ার বিস্তৃতি ক্রমে তরান্বিত হচ্ছে। চৈত্রের মধ্যভাগ থেকেই বরিশালে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকে ৬-৭ ডিগ্রির উপরে রয়েছে। ফলে ডায়রিয়া পরিস্থিতির অবনতিও অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, বরিশাল অঞ্চলে বছর জুড়েই কমবেশী ডায়রিয়া রোগী থাকলেও এবার অস্বাভাবিক তাপ প্রবাহ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে।
আবহাওয়া বিভাগের হিসেবে চলতি মাসে বরিশালে স্বাভাবিক ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের স্থলে তাপমাত্রার পারদ মে মাসের প্রথম দিন ৩৮ ডিগ্রিতে উঠে যায়। গত রোববার বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরে তাপমাত্রা কিছুটা নিচে নামলেও গত দুদিন ধরেই তা আবার বাড়ছে। বৃহস্পতিবারেও বরিশালে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের প্রায় ৩ ডিগ্রি বেশী, ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অথচ চলতি মাসে বরিশালে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনকি অব্যাহত অস্বাভাবিক তাপ প্রবাহের মধ্যেই নজিরবিহীন বৃষ্টির ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। গত এপ্রিলে বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের ৮৬% কম। আবহাওয়া বিভাগ থেকে এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাতের খবর জানিয়ে ৬-৮ দিনে বরিশালে ১২০ থেকে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিলেও মাসের শেষের যোগ ফলে মাত্র ১৯ মি.লি বৃষ্টি জমেছে। মার্চ মাসেও বরিশালে স্বাভাবিকের ৩০% কম বৃষ্টি হয়েছে।
এরই মধ্যে ডায়রিয়া ও পেটের পীড়ার বিস্তৃতি পরিস্থিতিকে যথেষ্ঠ নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। চলতি মাসেও বরিশালে স্বাভাবিক ২৪৫ মিলিমিটারের স্থলে ২৬০-৩১০ মিলি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হলেও মাসের প্রথম ১৫ দিনে বৃষ্টি হয়েছে ১৩৭ মিলিমিটার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল এবং জেলা সিভিল সার্জনসহ সর্বস্তরের চিকিৎসকগণ এ গরমের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রচুর পরিমানে বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনে খাবার স্যালাইন পান করার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি পথ খাবারের দোকানের খাবার সম্পূর্ণ পরিহারের কোন বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন। বিভাগীয় পরিচালক, ডায়রিয়া চিকিৎসায় বরিশালে প্রায় ২৭ হাজার ব্যাগ আইভি স্যালাইন এবং প্রচুর ক্যাপসুলসহ সব ধরনের চিকিৎসা সামগ্রী মজুদের কথাও জানিয়েছেন। অনুমোদিত জনবলের অর্ধেকেরও বেশী চিকিৎসকের পদ শূণ্যের মধ্যেও ডায়রিয়াসহ যেকোন জরুরী চিকিৎসায় কোন সংকট হবে না বলেও দাবি করে তিনি ডায়রিয়া ও ডেঙ্গুসহ যেকোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালসহ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবারও তাগিদ দিয়েছেন।