বরিশালের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে এক রোগীর পুত্রকে ডাক্তারের মারধর ও রোগীকে সেবা প্রদান না করে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মারধরকারী ডা.বাবুল কুমার সাহা হাসপাতালটির অর্থোপেডিক সার্জন ।
এ ঘটনায় হামলাকারী ডাক্তারের বিরুদ্ধে ভিজিট দেয়ার পরেও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, ক্ষতিপুরন ও মারধরের বিচার চেয়ে রোগীর পুত্র মোঃ রাজিব সিকদার ৪ জুন বরিশাল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট এর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বিকার করে হাসপাতালটির সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মোহাম্মদ ইসতিয়াক হোসেন বলেন এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়,বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দির কালাম সিকদারকে ৪ জুন ২৪ তারিখ সকালে ইসলামী ব্যাংক চাদঁমারী,বরিশালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য নেয়া হয়।কুড়ালের কোপে কালাম শিকদারের পায়ের গোস্ত ও হাড় কেটে যায়।হাসপাতালে অর্থপেডিক্স সার্জন ডাঃ বাবুল কুমার সাহার নিকট রোগীকে নেয়া হলে তিনি সাত শত টাকা ভিজিট নিয়ে শুধু এক্সরে ও ব্লাড পরীক্ষা করার জন্য বলে।পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে রিপোর্ট নিয়ে ডাঃ বাবুল কুমার সাহার কাছে গেলে তিনি বলেন দুপুরে খাবারের পরে সেলাই করে দিব।ডাক্তার কোন চিকিৎসা সেবা এমনকি ব্যথা বন্ধে কোন ঔষধ,সেলাই বা ড্রেসিং না করার ফলে রোগী ট্রলিতে বসে কাতরাচ্ছিলেন।কোন প্রকার চিকিৎসা না দিয়ে ডাঃ বাবুল কুমার সাহা চলে যান।পুন:রায় বিকেল চারটায় হাসপাতালে এসে রোগী কালাম সিকদারকে কোন চিকিৎসাপত্র না দিয়ে সময় ক্ষেপন করে। বিকেল সাড়ে পাচঁটার দিকে হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে নিয়ে যেতে বলেন ডাক্তার। অপারেশন থিয়েটারে রোগীর পুত্র রাজিবের নিকট ডাক্তার সাহা দশ হাজার টাকা তাৎক্ষনিক পরিশোধের কথা বলে। রাজিব টাকা দিবে বলে তার পিতার চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেন। টাকা ছাড়া কোন চিকিৎসা সেবা দেয়া যাবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেন ডাক্তার বাবুল কুমার সাহা।এ নিয়ে কথাকাটাকাটির পরে ডাঃ বাবুল কুমার সাহা রোগীকে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে রোগীর পুত্র রাজিবকে মারধর করে রোগীকে অন্যকোন হাসপাতালে যাওয়ার আদেশ দেন।রোগীর স্বজনরা কোন উপায় না পেয়ে ৪ জুন রাতে রোগী কালামকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।বর্তমানে তিনি অর্থপেডিক্স ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
লিখিত আবেদনে ডাঃ বাবুল কুমার সাহার বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলা,মারধর ও রোগীর ক্ষতিপুরনসহ সুষ্ঠ বিচারের দাবী করা হয়। রোগীর পুত্রকে ডাক্তার কর্তৃক মারধরের ঘটনা ছড়িয়ে পরলে সবাই ধিক্কার জানান।
এ ব্যাপারে রোগী কালাম সিকদার জানান,আমি ভিজিট দেয়ার পরেও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডাক্তার বাবুল কুমার সাহার কাছে কোন চিকিৎসা সেবা পাইনি। বরংচ তার অবহেলার কারনে আমি বড় কস্ট পেয়েছি। আমরা তার বিচার চাই।আমারমত কোন রোগী যেন কস্ট না পায়।
এ ব্যাপারে রোগীর সাথে থাকা রোগীর পুত্র রাজিব জানান,আমি ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট এর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করলে আমরা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিবো।রাজিব আরো জানান,আমি আমার বাবার চিকিৎসার কথা বলার পরেই ডাক্তার ও তার সাথের এক সহকারি আমাকে প্রচন্ড রকম মারধর করে। তিনি উপযুক্ত বিচার দাবী করেন।
রোগীকে মারধরের ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাক্তার বাবুল কুমার সাহার মোবাইলে ৬ জুন সকাল দশটা ২১ মিনিটের সময় কল করা হলে তার সহকারী পরিচয় দিয়ে বলেন স্যার বাথ রুমে আছেন।
পুন:রায় দশটা ৫৩ মিনিটের সময় কল করা হলে একই ব্যক্তি জানান স্যার বাথরুমে আছেন। আধা ঘন্টারও বেশী সময় বাথরুমে থাকার ফলে ডাঃ বাবুল কুমার সাহার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ঘটনার সময় উপস্থিত এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সত্যতা স্বিকার করে বলেন, রোগী ও রোগীর পুত্রের সাথে ডাঃ বাবুল কুমার সাহা যা করেছেন তা দুঃখজনক এবং হাসপাতালের বদনাম করেছেন।ঘটনাটি বেদনাদায়ক।
বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্থ রোগী কালাম সিকদার বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক্স ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কর্তব্যরত চিকিৎসারা জানিয়েছেন ঘটনার পর সুচিকিৎসা না পাওয়ায় কালাম সিকদারের পায়ের অবস্থা খারাপ হয়েছে।তাৎক্ষনিক চিকিৎসাসেবা পেলে তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হতোনা।বেশ কিছুদিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।
চিকিৎসায় অবহেলার আইন ও আইনগত প্রতিকার :
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘স্বাস্থ্য’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৮ অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিমান এবং ‘গণ-স্বাস্থ্য’ সুরক্ষার কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২-এ বর্ণিত ‘জীবন রক্ষার অধিকার’ একটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য। চিকিৎসায় অবহেলা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যর্থতা এই জীবন রক্ষার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। তাই চিকিৎসায় অবহেলা হলে সর্বোচ্চ আদালতে রিট বা জনস্বার্থে মামলা করার সুযোগ আছে।
১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি বাংলাদেশের প্রধান ফৌজদারি আইন। দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারানুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি বেপরোয়া বা অবহেলামূলক কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটায়, তাহলে সেটি ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৪ ধারায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গর্ভপাত ঘটানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ২৭৪, ২৭৫ ও ২৭৬ ধারায় যথাক্রমে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামে ভেজাল মেশানো, ভেজাল ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি এবং এক ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্য নামে বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এসব অপরাধ দমন ও আইনি প্রতিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের মাধ্যমে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় এবং শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার প্রতি ডাক্তারদের অতি আগ্রহ এবং প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি গজিয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স। তবে এই আইনের উদ্দেশ্য খুব সামান্যই পূরণ হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী লাইসেন্সবিহীন প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। লাইসেন্স পাওয়ার শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সুব্যবস্থা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং অস্ত্রোপচার ও ডাক্তারি পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা। এই আইনের আওতায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে শুরু করে ক্লিনিক, ল্যাব, হাসপাতাল প্রভৃতির লাইসেন্স প্রদান করা, মান নিয়ন্ত্রণ করা, পরিদর্শন করা এবং অনিয়ম দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব। এমনকি এই আইনের অধীনে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক প্রভৃতির অব্যবস্থাপনার জন্য আদালতে মামলা করার ক্ষমতা একমাত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে।
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৯ ধারা অনুসারে কারও অবহেলাজনিত কাজের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্থানীয় দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে কোনো রোগী ফির বিনিময়ে ডাক্তার, হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবা গ্রহণ করলে তিনি ‘ভোক্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত অবহেলার শিকার হলে ভোক্তা অধিকার আইনে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অভিযোগ করতে পারবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার যদি রোগনির্ণয়ে ভুল বা অবহেলা করে, ফলে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা যদি সেবা প্রদানে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে, তাহলে ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করা যাবে। এই আইন অনুসারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাপ্য হবেন।
চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসেবার মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। কোনো চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের অবহেলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় অবস্থিত বিএমডিসিতে অভিযোগ করা যায়। মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০–এর ধারা-২৩ অনুসারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা বিএমডিসির রয়েছে।
চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।
বিএমডিসির নিয়মানুযায়ী, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর অভিযোগকারীকে জানানো হবে।
তিনি তা গ্রহণ না করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে।