More

    দখল–দূষণে মৃতপ্রায় বরিশালের টরকী-বাশাইল খাল, সেচসংকটে কৃষকেরা

    অবশ্যই পরুন

    বরিশালের আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহী টরকী–বাশাইল খালটি এখন মৃতপ্রায়। নাব্যতাসংকট, দখল, দূষণ ও অবহেলায় খালটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে খালের পানিনির্ভর কয়েক হাজার কৃষকের জীবন-জীবিকা এখন বিপন্ন, হুমকিতে পড়েছে প্রকৃতি ও স্থানীয় জনস্বাস্থ্য। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায় প্রতিবছর ব্যাপক বোরো আবাদ হয়। খালটির ওপর দুই উপজেলার প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আবাদের সেচ নির্ভরশীল।

    খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় এখন কৃষকেরা সেচ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে দুটি পাম্প দিয়ে প্রথমে খালে পানি আনে। এরপর খাল থেকে পুনরায় পাম্প দিয়ে খেতে সেচ দেন। এতে দুইবার (ডাবল লিফটিং) পানি তোলায় কুষকদের সেচ খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। গৌরনদীর টরকী বন্দরসংলগ্ন পালরদী নদীর মোহনা থেকে শুরু হয়ে ধানডোবা, রাজাপুর, সাদ্দাম বাজার, মোক্তার বাজার ও চেঙ্গুটিয়া হয়ে বাশাইল বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই খাল একসময় ছিল স্থানীয় মানুষের চলাচলের পথ ও সেচের উৎস।

    এখন খালের বুকজুড়ে পলি, আবর্জনা। একই সঙ্গে দুই পাড় দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি অস্তিত্ব বিপন্নের পথে। সরেজমিন দেখা যায়, খালটির টরকী বন্দর প্রান্তে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে দুই পাড় দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বন্দরের পূর্ব পাশ পালরদী নদীর সংযোগ মুখ থেকে খালের উত্তরে টরকী স মিলের পাশে খাল ভরাট করে এসব পাকা, আধাপাকা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দখলের পরিধি বাড়ানো বাড়ানো হচ্ছে। এতে সংকুচিত হয়ে পাঁচ-ছয় ফুট প্রস্থে এসে পৌঁছেছে।

    দখলের বিষয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, ‘আমার রেকর্ডীয় সম্পত্তির অংশ খালে থাকায় তা ভরাট করেছি।’ একই সঙ্গে দখলদার জাকির হোসেন, আজিজ মাল, রুহুল সিকদার, রব সিকদার, মো. ফরহাদ হোসেন, কমল রায়, শাহ আলম খান, শামীম খান, আকতার হোসেন খালের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে বলেন, তাঁরা জমি ইজারা নিয়ে ভোগ দখল করেছেন।

    তবে গৌরনদী ভূমি কার্যালয় সূত্র বলছে, খালের জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। দুই পাড়ের বাসিন্দারা গোসল ও নিত্যদিনের গৃহস্থালির কাজে এই পানি ব্যবহার করতেন। কিন্তু ছয়-সাত বছর ধরে খালে পানি না থাকায় তাঁরা সংকটে পড়েছেন। একই সঙ্গে খালের পানির প্রবাহ না থাকায় বদ্ধ পানিতে মশা-মাছি উৎপাদনের উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে। তারাকুপি গ্রামের বাসিন্দা হালিম শাহ বলেন, শুষ্ক মৌসুমে গৃহস্থালি কাজে পানির খুব সংকট হয়। বদ্ধ খালের পানি পচে দুর্গন্ধ হয়ে যায়। এতে মশা-মাছির উৎপাতে টেকা দায়। টরকী-বাসাইল খালে মূলত আড়িয়াল খাঁ নদের শাখা পলরদী নদী থেকে পানি প্রবেশ করে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে গেলে খালে পানি প্রবেশ করে না।

    বর্তমানে প্রবেশমুখে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে নদী থেকে খালে পানি ওঠানো হয়। আমাদের শৈশবে খালটিতে এমন প্রবাহ ছিল যে সাঁতরে ওপার যাওয়া কঠিন ছিল। এখন সেখানে হাঁটলেও কাদা ছাড়া কিছু নেই। কটকস্থল গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন, আনন্দপুর গ্রামের সানাউল হকসহ কয়েকজন জানান, খালের দুই পাশে অন্তত ২০টি বোরো প্রকল্পে সেচ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন দ্বিগুণ খরচ দিয়ে সেচের পানি কিনতে হয়। এ জন্য অনেক কৃষক বোরো চাষ বাদ দিয়ে কেউ মাছের ঘের, কেউ পানের বরজ দিয়েছেন। আর যাঁরা বোরো আবাদ করছেন, তাঁরা আবাদি জমি কমিয়ে দিয়েছেন।

    কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবারও তিনি সাড়ে তিন একর জমিতে বোরো আবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিন বছর আগেও প্রায় পাঁচ একর জমিতে বোরো আবাদ করতেন। লাভ না হওয়ায় চাষাবাদ কমিয়ে দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আগে প্রতি ২০ শতক জমিতে সেচ দিতে ৭০০ টাকা ব্যয় হতো। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ২০০ টাকা লাগে। স্থানীয় পরিবেশ কর্মী সৈয়দ মাজারুল ইসলাম বলেন, পালরদী নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এখন আর খালে পানি প্রবেশ করে না।

    অপরিকল্পিত বাঁধ ও সেতু নির্মাণ, খালের জমি দখল এবং নির্বিচার আবর্জনা ফেলার কারণে এ খালটির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। গত বছর বোরো মৌসুমের আগে কৃষকেরা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে লিখিতভাবে খাল খননের আবেদন করলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের গৌরনদী উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী সাহেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, বোরো চাষের সেচের জন্য খালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    তাঁরা খালটি খননের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু টরকী বন্দরের প্রান্তে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা থাকায় সেটি করা যাচ্ছে না। কারণ, খননযন্ত্র পরিচালনার জন্য জায়গা দরকার। আবার খনন করা মাটি পাড়ে রাখার জন্যও জায়গা দরকার। সেই পরিমাণ জায়গা সেখানে নেই। কৃষকদের খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে সাহেদ আহমেদ বলেন, ওখানে ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্প দিয়ে একটি সেচ প্রকল্প করে দেওয়া হয়েছে। কৃষকেরাই এটা পরিচালনা করেন।

    কিন্তু ডাবল লিফটিংয়ের কৃষকদের সেচ ব্যয় বেড়ে যায়, এটা সত্যি। বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন খালটির এই দুরবস্থার বিষয়ে বলেন, ‘খাল ও নদী খনন করলে যেমন জলাবদ্ধতা নিরসন হবে, তেমনি পতিত জমিও নতুন করে আবাদে আসবে। ইতিমধ্যে বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাল খননের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

    আশা করছি, শিগগিরই বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ ওই এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য ছাদের আলী সরদার বলেন, ‘আমাদের শৈশবে খালটিতে এমন প্রবাহ ছিল যে সাঁতরে ওপার যাওয়া কঠিন ছিল। এখন সেখানে হাঁটলেও কাদা ছাড়া কিছু নেই। বহুবার জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েছি, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    ঝটিকা মিছিল থেকে আ’লীগের ৩০০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার

    চলতি বছর রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় তিন হাজার আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন...