বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও এর হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের শতকরা ১০ ভাগ মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। একথা সঠিক যে আসলে বিশ্বের কত কোটি মানুষ প্রতিবন্ধী তার সঠিক হিসাব আমরা কেউ জানিনা। তবে এ কথা আমরা সবাই দেখি প্রতিটি প্রতিবন্ধীদের জীবন প্রচন্ড কষ্ট ও সংগ্রামের দুঃখ ও কস্টে ভরা থাকে সারাজীবন । “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য” এ কথাটি আমরা গানের মধ্যেও প্রতিনিয়ত শুনি। জীবন মানেই যুদ্ধ। যন্ত্রণাময় এই জীবন সংসারে জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের কমলাপুরের বাসিন্দা প্রতিবন্ধী মন্নান মেলকার। বয়স ৪০ বছর।
মন্নানের পিতা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। দিনমজুর বাবার নিজস্ব ভিটাবাড়ি না থাকায় বসবাস করতেন নানার বাড়িতে। তার দুই ছেলে বড় ছেলে ছোটবেলা হারিয়ে যাওয়ায় ছোট ছেলে মন্নানকে নিয়েছিল তাদের সংসার। দিনমজুর বাবার কোনরকম সংসার চালাতেন।ভালোই কাটতেছিলো তাদের জীবন। হঠাৎ মন্নানের নয় বছর বয়সে বাত জ্বরের কারণে পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালির নিচ পর্যন্ত প্রচুর ব্যথা শুরু হয় তখন তার বাবা-মা ডাক্তার কবিরাজের কাছে নিয়ে যান এবং তার চিকিৎসা করান। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতেন। এভাবেই চলতেছিল তাদের জীবন। হঠাৎ মন্নানের বয়স যখন ১২ বছর তখন তার বাবা মারা যান। পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে। সংসার চালাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিন চাকার ভ্যান চালানো শুরু করেন। তিন চাকার ভ্যানের প্যাডেলে তার পায়ের ব্যথা নিয়ে চালানো ভ্যানের সাথে চলতে থাকে তাদের সংসারের চাকা।
বিয়ে সাদী করেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ২০০৮ সালের দিকে তিনি বিয়ে করেন। এখন তার সংসারে ৮ বছরের একটি মেয়ে, চার বছরের এবং দুই বছরের ছেলে, স্ত্রীএবং বৃদ্ধ মা।
মন্নানের সুখের সংসারে শান্তি বেশিদিন রইল না। ৬-৭ মাস আগে বাম পায়ের মধ্যে পচন ধরছে এরমধ্যে। ডাক্তারের শরনাপন্ন হলে ডাক্তার পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে রাহাত আনোয়ার মেডিকেলে মরহুম ডাক্তার আনোয়ার তার অপারেশন করে বাম পা কেটে ফেলেন। অপারেশনের খরচ ১ লক্ষ টাকা তখন সমাজের বিত্তবানদের কাছে সাহায্য চেয়ে সংগ্রহ করা হয়। দুঃখ যেন পিছু ছাড়ল না মন্নানের। এরমধ্যে পচন দেখা দিল ডান পায়ে। ডাক্তার উপদেশ দিলেন ডান পা কেটে ফেলতে। ডান পা টিকিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত ঔষধ সেবন করে যাচ্ছেন। যার খরচ প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা। তার চিকিৎসার খরচ এবং সংসারের খরচ বহন করার জন্য ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ মা মাঝে মাঝে অন্যের বাড়ি কাজ করেন।
সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মন্নানের চোখ যেনো পানিতে ছল ছল করে উঠলো। কারণ তিনিতো একজন বাবা। যখন তার বাম পা কেটে ফেলা হয় চলাচলের জন্য তিনি ছিলেন অনুপোযোগী। নানার বাড়িতে যেতে হলে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যেতে হতো তাই স্থানীয়রা রাস্তার পাশে একটি ছোট্ট ঘরে থাকার সুযোগ করে দেন। সেখানেই কাটছে প্রতিবন্ধী মান্নানের জীবন। কেমন কাটছে এখন মন্নানের জীবন? সরকারি অনুদান কি তিনি পান? প্রশ্ন করতেই চোখে একগুচ্ছ পানি নিয়ে শুধু উত্তর দেন এখন পর্যন্ত তিনি শুধু করোনার মধ্যে ২০ কেজি চাল পেয়েছেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সাহায্য ২৫০০ টাকা তিনি পাননি। পেয়েছেন শুধু প্রতিবন্ধী ভাতা। জানতে চাইলাম চলছেন কিভাবে? উত্তর দিলেন মা এবং স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করেন এবং তিনি নিজে টুকটাক কিছু কাজ করেন সেখান থেকে যা আসে তা দিয়েই সংসার চলতেছে এবং স্থানীয় কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি তাঁকে সহযোগিতা করেন। চোখের পানি ছেড়ে শুধু বলেন সন্তানদের নিয়ে এভাবে আর কতদিন?
তার একটি পা নেই অন্য একটি পা পচন ধরেছে কিন্তু স্বপ্ন যেন থেমে থাকেনি। স্বপ্ন দেখেন নতুন কিছু করার, স্বপ্ন দেখেন স্বাবলম্বী হওয়ার, স্বপ্ন দেখেন সন্তানদের অদূর ভবিষ্যতের, স্বপ্ন দেখেন সন্তানদেরকে লেখাপড়া করার, স্বপ্ন দেখেন সন্তানদেরকে মানুষের মত মানুষ করার, যার জন্য নিজের চিকিৎসার কিছু অর্থ সঞ্চয় করে অল্প কিছু মুরগি নিয়ে ছোট্ট একটি মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন রাস্তার পাশে দেয়া বাসস্থানের সেই ছোট্ট ঘড়ে। সত্যি তার স্বপ্ন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার স্বপ্নই তাকে নতুন জীবনের বাঁচার আশার সঞ্চার করছে। যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি প্রতিবন্ধী মন্নানের সাথে যোগাযোগ করতে চান তাকে ফোন করতে পারেন এই নাম্বারে 01312790980।