বরিশাল নিউজ ডেস্ক : ‘চারদিকেই আগুন দাউ -দাউ করে জ্বলছিল। অথৈ পানি থাকা সত্ত্বেও আগুনে পানি দেয়ার মতো কারো সুযোগ ছিল না। অনেকের মতো আমরাও লঞ্চ থেকে লাফ দিই। প্রাণে বেঁচে যাই। এক বছর পার হলেও প্রতি মুহূর্ত শিউরে উঠি। লাশের সারি চোখে ভাসে। ’
২০২১ সালের বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করলেন মাধবী কর্মকার। তিনি বরগুনার পাথরঘাটার সাংবাদিক বিনয় ভূষন কর্মকার খোকনের সহধর্মিণী। সেদিন গভীর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে লাগা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি।
নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বাঁচলেও দুঃসহ সেই ঘটনায় মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি ও তার ছেলে-মেয়ে।
মাধবী কর্মকার বলেন, এখনো মনে পড়লে আঁতকে উঠি। বিশেষ করে আমার ছেলে ও মেয়ে ওদের মনে এখনো ভয় কাজ করে। এ জন্য অনেক চিকিৎসাও করিয়েছি। এখনো ওদের মনের ধাক্কা ভুলতে পারেনি। মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। মৃত্যুর ভয়াবহতা এমন ছিল যে মৃত্যু কত যন্ত্রনা তা না দেখলে বোঝা যাবে না।
কীভাবে প্রাণে বাঁচলেন সে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তিনজন যখন লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ি। মেয়ে সাঁতার না জানায় কয়েকবার হাত থেকে ছুটে গিয়েছিল। ছেলে শুভ আমাকে কুলে উঠিয়ে মেয়েকে খুঁজে পায়। মেয়েকে ফিরে পাবো ভাবতেও পারিনি। ভোর হওয়ার পর দেখি লাশ আর লাশ।
মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা শুভ কর্মকার বলেন, আগুনের লেলিহান শিখা দেখে কেবিন থেকে ব্যাগ নিয়ে তিনজন বের হয়ে লঞ্চের ডেকের সামনে যাত্রী ওঠা নামার স্থানে চলে আসি। প্রথমে মা শাড়ি পড়নে থাকায় তাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। আমার হাত থেকে কয়েকবার মায়ের হাত ছুটে যায়। অনেক কষ্ট করে মাকে নিয়ে কুলে নিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর লঞ্চে বোনকে আনতে যাই। সাঁতার না জানা বোন দেবস্মিতাকে নিয়ে ও ব্যাগ নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। কয়েকবার বোনের হাত ছুটে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কাছাকাছি থাকায় সন্ধান পাই। বহু কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হই।
তিনি আরও বলেন, আমি একাই সাঁতার জানি, মা-বোন সাঁতার জানে না। সৃষ্টিকর্তা আমাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছিলেন তখন। নদীতে ঝাঁপ না দিলে আগুনের লেলিহানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। পৃথিবীর আলো আর দেখতে পেতাম না।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ গার্মেন্টসকর্মী ফজিলা আক্তার পপির মা আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন,২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঘটে এক ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনা। ওই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় ফজিলা আক্তার পপিও ছিলেন। এক বছর পার হয়ে গেলেও আজও সন্ধান মেলেনি বরগুনার পাথরঘাটার ফজিলা আক্তার পপির ।
তিনি বলেন,এক বছর ধরে পথপানে চেয়ে আছে একমাত্র মেয়ে লামিয়াসহ (১৪) পরিবারের স্বজনরা। প্রতি মুহূর্তই যেন পপির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে দিন পার করছেন পরিবারের সদস্যরা। নিখোঁজ ফজিলা আক্তার পপি (২৫) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে। পারিবারিক কলহের কারণে ৮ বছর আগে স্বামী সামছুল ইসলামকে তালাক দেয় পপি।
স্বজনরা দুর্ঘটনার পর এমভি অভিযান-১০ লঞ্চসহ ঝালকাঠি ও বরগুনা সদর হাসপাতালের মর্গে এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়েও তার সন্ধান পাননি। পরে বরগুনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিএনএ নমুনা দিয়েও মেলেনি শনাক্ত।
পপি ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে পাথরঘাটায় অভিযান-১০ লঞ্চে রওনা হন। একমাত্র মেয়ে লামিয়াকে (১৩) বাবার বাড়ি থেকে নিজ কর্মস্থল ঢাকার সাভারে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য নিতে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পপির ইচ্ছে পূরণ হলো না।
পপির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা,আজও পথপানে চেয়ে আছে বাবা আফজাল হোসেন, মা আমেনা বেগম ও একমাত্র মেয়ে সন্তান লামিয়া। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, প্রতিবেশীরাও অপেক্ষা করছেন পপির জন্য। নিখোঁজের এক বছর হলেও আত্মীয়-স্বজনরাও আসছেন তাদের সান্ত্বনা দিতে।
পপির বৃদ্ধ বাবা আফজাল হোসেন বলেন, একমাত্র মাইয়াডারে হারাইলাম। এহন ক্যামনে থাকমু। জামাই মাইয়াডারে ৮ বছর আগে তালাক দিয়া যায়। জীবন বাঁচাইতে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতো। মাইয়াডার লাশটা পাইলেও কবরডা দেখতাম।
পপির মা আমেনা বেগম আরও বলেন, সন্তানহারা মা কিভাবে থাকে। সন্তানের অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না। খুব কষ্টে দিন পার করছি। পপি লঞ্চে ওঠার সময় ফোন দিয়া বলছিলো- মা ছুটি কম, রুটি পিঠা খাইতে মন চায়। যা খাওয়াবা জলদি খাওয়াবা। সকালে হুনি যে লঞ্চে আমার মাইয়াডা ছিল ওইডাই আগুনে পুইরা গ্যাছে। আর মোর মাইয়াডা আইলেও না, রুটি পিডাও খাওয়াইতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত মোর মায় আর নাই। গার্মেন্টসে ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিল, ছুটিতে আসার দুদিন আগেও মোর মাইয়াডা আগুন লাগলে কিভাবে নেভাতে হয় এবং বাঁচার উপায় নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছে কয়েকশ কর্মীকে। কিন্তু সে নিজেই আগুনে পুইড়া গেল।
পপির ১৪ বছরের একমাত্র মেয়ে লামিয়া বলে, মায় কইছিল, বাড়িতে আইয়া মোরে ঢাকায় নিয়া ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করাইবে। এহনো মায় আয় নাই। হুনছি যে লঞ্চে আগুন লাগছে হেই লঞ্চেই মোর মায় আছিল। এহন মোরে মা কইয়া কেডা বোলাইবে। মোর মায় কি আইবে?
লামিয়া আরও বলে, মায়রে সব সময়ই মনে পড়ে, মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখি। গত ৮ মাস বাবার কাছে ছিলাম, এহন নানা বাড়িতে থাকবো।
বরিশাল নিউজ/এসএলটি