হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থকের শেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার, ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে। টানা দুদিন শ্রদ্ধা জানানোর পর বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার মধ্যরাতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনবার বিশ্বকাপজয়ী এই মহতারকাকে। কালো মানিককে শেষ বিদায় জানাতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার ভক্ত-সমর্থকরা। ক্যান্সার ও বার্ধক্যজনিত নানাবিধ অসুস্থতার কারণে ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান পেলে।
ক্যারিয়ারের শেষ দুই বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল- এই সময়ে পেলে খেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসে। এর আগে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ১৮ বছর খেলেন নিজ দেশের ক্লাব সান্টোসে। মারা যাওয়ার আগে পেলে নিজেই বলে গিয়েছিলেন, তার মরদেহ যেন সান্টোসের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। তার চাওয়া অনুযায়ী সান্টোসের মাঠ ভিলা বেলমিরোতে ২৪ ঘণ্টার জন্য রাখা হয়েছিল পেলের মরদেহ। ব্রাজিলের মানুষ ফুটবলের রাজাকে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যরে খবরে জানা গেছে, সোমবার পেলের কফিন আনা হয় সান্টোস ক্লাব প্রাঙ্গণে। জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্টেডিয়ামের মাঝমাঠে ২৪ ঘণ্টা রাখা হয় পেলের কফিন। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সমাধিস্থলে। সেখানে যাওয়ার আগে সান্টোসের রাস্তায় পেলের শেষ যাত্রা হয় ক্যানাল ৬ সড়ক দিয়ে। যেখানে ফুটবলের রাজার মা থাকেন। ১০০ বছর বয়সী পেলের মা শয্যাশায়ী। ছেলেকে চিনতে না পারলেও শেষবারের মতো মায়ের আদরমাখা পরশ বুলিয়ে দেন মা সেলেস্টে আরান্টেস। এ সময় সাওপাওলোর বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে পেলের স্মরণে মিছিলও করা হয়। সান্টোস স্টেডিয়ামে গিয়ে সেই মিছিল শেষ হয়। স্টেডিয়ামে তিনটি বিরাট পতাকা ছিল। যার একটিতে পেলের ছবি ও ১০ নম্বর জার্সি আঁকা। অন্য একটিতে লেখা ছিল, ‘রাজা দীর্ঘজীবী হোন’।
যে ক্লাবের মধ্য দিয়ে ফুটবলের রাজার রূপকথার অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল সান্টোসের সেই ভিলা বেলমিরো ক্লাবেই হয়েছে পেলের শেষকৃত্য। হাজারো ভক্ত-সমর্থকের সঙ্গে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্টিনোসহ বিশে^র অনেক ফুটবল অনুরাগীরা। মাঠের মাঝখানে শেষবারের মতো রাজাকে দেখতে রাত পর্যন্ত ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এ সময় পেলের কফিন ব্রাজিল ও সান্টোসের পতাকা দিয়ে আবৃত ছিল। সঙ্গে ছিল সাদা ফুল। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুজি ইনাসিও লুলা ডা সিলভা ও তার স্ত্রী পেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দক্ষিণ আমেরিকান ও ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রধানদের সঙ্গে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন ইনফান্টিনো। এ সময় ফিফা সভাপতি বলেন, ‘পেলে চিরন্তন, তিনি বিশ^ ফুটবলের একজন আইকন।’
শেষকৃত্যে যোগ দিতে আসা পেলের ভক্তদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৫৯ বছর বয়সী কার্লোস মোতা ও তার ১২ বছরের ছেলে বার্নান্ডো। রিও ডি জেনিরো থেকে ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি পাড়ি দিয়ে তারা পেলেকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
আবেগ মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কার্লোস মোতা বলেন, ‘ব্রাজিলের জন্য পেলে যা করেছে তা ছোটবেলা থেকেই আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। সে আমাদের জাতীয় নায়ক। আমি সবসময়ই আমার ছেলেকে একটি কথাই বলি; আমার কাছে তিনটি অবিসংবাদিত তথ্য আছেÑ বলের আকার গোল, ঘাসের রং সবুজ এবং পেলে সর্বকালের সেরা ফুটবলার।’ বার্নান্ডো তার জীবনে বাবার এই শিক্ষা মনেপ্রাণে ধারণ করেন, ‘আমি কখনই পেলের খেলা সামনাসামনি দেখিনি। তবে আমি তার ভিডিও দেখেছি। সে এমন একজন সেরা খেলোয়াড় যে কখনো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারে না।’
সাধারণ মানুষের ভিড়ে হাজির ছিলেন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি গিলমার মেন্ডেস। তিনি বলেন, ‘খুবই দুঃখের মুহূর্ত। এখন বুঝতে পারছি আমাদের দেশের সেরা ফুটবলারের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কতটা। আমার দপ্তরে পেলের স্বাক্ষর করা জার্সি আছে। গোলরক্ষক হিসেবে তার একটি ছবিতেও স্বাক্ষর আছে। এছাড়া অনেক ডিভিডি, ছবি এবং আরও অনেক কিছু আছে। সর্বকালের সেরা এই ফুটবলার সবসময় অমর হয়ে থাকবেন।’ পেলের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি ব্রাজিলের বর্তমান সময়ের সেরা তারকা নেইমার। প্যারিস থেকে পিএসজি তারকার যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে নেইমারের পক্ষ থেকে তার বাবা সিনিয়র নেইমার পেলের প্রতি বিনম্র ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ।
বরিশাল নিউজ/স্ব/খ