More

    ভুয়া বিল করে শিল্পকলার অর্থ আত্মসাৎ, কর্মকর্তার গোমর ফাঁস করলেন ফুলঘর মালিক

    অবশ্যই পরুন

    বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার অসিত বরণ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কদিন আগে জেলা শিল্পকলা একাডেমি অনুমোদিত একটি বিলের ভাউচার নিয়ে বরিশাল নগরের সদর রোডের একটি ফুলের দোকানে গিয়ে দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, এই বিল তারা করেছেন কিনা। ফুল দোকানের মালিক মো. ইভান সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, ‘না না। আমরা এই বিল করিনি।’

    এই বিলের ভাউচারে একটি ফুলের তোড়া বাবদ পাঁচ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। ইভান বলেন, ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রায়ই আমার দোকান থেকে ফুলের তোড়া নেয়। যার বিল সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। তবে ফুলের তোড়া নেওয়ার সময় শিল্পকলা একাডেমি বিলের খালি পাতা নেয়। আমার ধারণা, খালি পাতায় পাঁচ হাজার টাকা বসিয়ে দিয়েছেন শিল্পকলার কর্মকর্তারা। ফুলের তোড়ার বিল আমরা ৫০০ টাকাই করি।’

    তাহলে কেন বিলের খালি পাতা দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ইভান বলেন, ‘ক্রেতা ধরে রাখতে এইটুকু সুযোগ দিতে হয়। না হয় পরে তারা আর ফুল কিনতে আসবে না।’

    একইভাবে এক হাজার ৮০০ টাকার আরেকটি বিল ভাউচারে ১৮ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। এভাবে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অসিত বরণ দাশগুপ্ত অর্থ আত্মসাৎ করছেন বলে জানা গেছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার হিসেবে অসিত বরণ দাশগুপ্ত গত ১২ জানুয়ারি যোগ দেন। এরপর থেকে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। যা নিয়ে বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

    সর্বশেষ রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এক হাজার ৮০০ টাকা করে ২৬টি সংগঠনে ৪৬ হাজার ৮০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কালচারাল কর্মকর্তা সেখানে ১৮ হাজার টাকা করে চার লাখ ৬৮ হাজার টাকার বিল করেন বলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক সংগঠক জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খাবার বাবদ অতিরিক্ত বিল করে টাকা আত্মসাৎ করছেন অভিযোগ রয়েছে।

    গত ৩০ জুন জেলা কালচারাল কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত নোটিশে সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। নোটিশে উল্লেখ করা হয় সাময়িক সময়ের জন্য এ কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, সে বিষয়ে কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। এতে শিল্পকলা একাডেমিতে দায়িত্বরত প্রশিক্ষকরা ক্ষুব্ধ হন। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কালচারাল কর্মকর্তা হাসানুর রশীদ শিল্পকলায় নিযুক্ত ১২ জন প্রশিক্ষকের ২০২৪-২৫ সালের চুক্তিনামা নবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে প্রশিক্ষকরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। নবায়নের জন্য কয়েক দফায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে গেছেন তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সুরাহা হয়নি। তাদের অভিযোগ, অসিত বরণ দাশগুপ্ত প্রশিক্ষক নিয়োগ নিয়েও দুর্নীতি করছেন।

    ইতিমধ্যেই অসিত বরণ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করে লিখিত অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। গত ১ জুলাই বরিশালের গণমাধ্যমকর্মী মুহম্মদ ইমন খন্দকার হৃদয় অভিযোগপত্রটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ওয়ারেছ হোসেন, বরিশালের জেলা প্রশাসক ও শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এবং দুদকের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এইচএম আক্তারুজ্জামানের বরাবর দাখিল করেন।

    অভিযোগপত্রে মুহম্মদ ইমন খন্দকার উল্লেখ করেন, অসিত বরণ দাশগুপ্ত ২০১৩ সালে কালচারাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে সিলেট, হবিগঞ্জ ও বর্তমানে বরিশালে দায়িত্ব পালনকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৬ সালে সিলেটে নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা স্মারকলিপি দেন। ২০২৪ সালে সিলেটে তার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করা হয়। ২০২৫ সালে তাকে বরিশালে বদলি করা হয়। বরিশালে যোগদানের পর থেকেই সরকারি রেস্ট হাউজে পরিবারসহ মাসের পর মাস অবৈধভাবে বসবাস করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। একইসঙ্গে হলরুম ভাড়ার টাকা গোপন রেখে তা ব্যক্তিগতভাবে এবং স্থানীয় ও সাধারণ ফান্ডের ২৯ লাখ টাকার একটি বড় অংশ তুলে আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।

    এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযোগকারী মুহম্মদ ইমন খন্দকার বলেন, ‘বরিশাল একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। এখানে কোনও দুর্নীতিবাজের ঠাঁই হতে পারে না। অসিত বরণ বরিশালের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কলুষিত করছেন। তার কর্মকাণ্ড জুলাই-আগস্ট চেতনার পরিপন্থি। এজন্য তার বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে তার শাস্তি দাবি করছি।’

    বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক সাব্বির নেওয়াজ সাগর বলেন, ‘জুলাই পরবর্তী বরিশাল শিল্পকলা একাডেমি ফ্যাসিবাদের দোসর ছাড়া সবার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান হবে এটাই আশা করেছিলাম। কিন্তু আমরা আশাহত হয়েছি। অসিত বরণ সিলেট ও হবিগঞ্জে কালচারাল অফিসার থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার কর্মকাণ্ড আগের মতো। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে আমরাও তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করবো।’

    লেখক গবেষক সাইফুল আহসান বুলবুল, নাট্যমের সংগঠক বাসুদেব ঘোষ, রিপন গুহ এবং শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের অনিমেষ লিটুসহ একাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী জানিয়েছেন, অসিত বরণ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। তিনি যোগদানের পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনও জানে। তারা বলছে তদন্ত করছে। তবে কতদূর এগিয়েছে তা জানা নেই। আমাদের পক্ষ থেকে দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত করে অসিত বরণের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। যাতে পরবর্তী কর্মকর্তা এ ধরনের দুর্নীতি করার আগে শতবার চিন্তা করেন।

    অভিযুক্ত জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তা অসিত বরণ দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি নিয়ম মেনেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’

    এক হাজার ৮০০ টাকার বিল ১৮ হাজার টাকা এবং ৫০০ টাকার ফুলের বিল পাঁচ হাজার টাকা কীভাবে দেখানো হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি কারা করেছে, তা আমার জানা নেই।’

    এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ও শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কালচারাল কর্মকর্তা অসিত বরণের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) উপমা ফারিসাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৮ আগস্ট থেকে তারা কাজ শুরু করেছেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

    তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উপমা ফারিসা বলেন, ‘লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

    এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানি না। নতুন যোগ দিয়েছি। তবে আজ থেকে বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তার অভিযোগের বিষয় নিয়ে কাজ করবো।’

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    নাজিরপুরে ভূমি কর্মকর্তার জব্দ করা বলগেট রহস্যজনকভাবে উধাও

    ডেস্ক রিপোর্ট : পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মধুমতি ও তালতলা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে নাজিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)...