জে এইচ রাজু, স্টাফ রিপোর্টার: দেশের মৎস্য সম্পদের অন্যতম গর্ব ইলিশ মাছ। দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় এর ভূমিকা অপরিসীম। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মা ইলিশ রক্ষার্থে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে সরকার ২২ দিনের জন্য ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন মূলত চার শ্রেণী পেশার মানুষ। সাধারণ জেলে, আড়তদার, খুচরা মাছ বিক্রেতা এবং ট্রলাক মালিকরা।
প্রধানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী ও সাগরকেন্দ্রিক জীবিকানির্ভর লক্ষাধিক জেলে পরিবার। এরা মূলত দিন আনে দিন খায়। সারা বছর ইলিশ শিকার করে যাদের সংসার চলে, তাদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা কার্যত এক মাসের আয় বন্ধ হওয়ার শামিল। ভোলার চরফ্যাশনে প্রায় লক্ষাধিক জেলে এখন কর্মহীন।
জেলেদের পাশাপাশি ইলিশ কেন্দ্রিক মাছ ব্যবসায়ী, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আড়তগুলো এই সময় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। ফলে হাজার হাজার মানুষ অস্থায়ীভাবে বেকার হয়ে পড়েন।
নিষেধাজ্ঞার সময় নদীতে কোনো জেলে যেতে না পারায়, ট্রলার মালিকরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। মাছ ধরার বড় ট্রলার বা নৌকাগুলোতে সাধারণত ১০-১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন, যাদের নির্ভরতা শুধুই মাছ ধরার উপর। এ সময় না চলে ট্রলার, না হয় আয়।
জেলে খোরশেদ বলেন, “নিষেধাজ্ঞা মেনে নদীতে যাই না। কিন্তু ঘরে খাবার নাই, বাচ্চাদের স্কুলের ফি বাকি পড়ে আছে। সরকারের চাল পাইনি এখনও।” সরকার প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞাকালীন সময় জেলেদের জন্য ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ রাখে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক জেলেই সময়মতো এই চাল পান না বা দুর্নীতির কারণে তা যথাযথভাবে বিতরণ হয় না। এছাড়া শুধুমাত্র চাল দিয়ে পরিবারের সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয় না।”
খুচরা মাছ বিক্রেতা জয়নাল বলেন, “আমি উপজেলার কয়েকটি বাজারে মাছ বিক্রি করছি। ফজরের আজানের সময় ঘর থেকে বের হয়ে কয়েকটি মৎস্যঘাট ঘুরে মাছ সংগ্রহ করে বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে আমার সংসার। অনেক সময়ে লোকসান গুনতে হয়। ঋণের জর্জরিত। নিষেধাজ্ঞা সময়ে একেবারেই বেকার। কিভাবে সংসার চালাবো ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবো তা চিন্তিত। তবে জেলেরা সরকারের বরাদ্দকৃত চাল পেলেও আমরা যারা মাছ বিক্রেতা আছি, তারা চাল পায়না।
আড়ত মালিক আলাউদ্দিন বলেন, “সারা বছর ইলিশের মৌসুমে ৫ জন শ্রমিক আমার আড়তে কাজ করে। এখন সবাই বসে আছে। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিকের অগ্রিম কিছুই মেটানো যাচ্ছে না। এছাড়া আমরা আড়ত মালিকরা লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ট্রলার মালিকদের দাদন দিয়েছি। নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় আমাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আয় বন্ধ হলেও ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া পরিবহনকর্মীরাও এই সময় আর্থিক সংকটে পড়েন। ইলিশ পরিবহনের সাথে জড়িত পিকআপ, ট্রাক, নৌযান এই সময় বন্ধ থাকে। ফলে চালক ও হেল্পারদের হাতে কোনো কাজ থাকে না।”
সমুদ্রগামী ট্রলার মালিক সালাউদ্দিন বলেন,“ ট্রলার বন্ধ, মাসে লাখ টাকা কিস্তি, তেল ও বরফের টাকা আগেই ঋণ নিয়ে নিয়েছি। এখন ইলিশ ধরতে পারছিনা, দেনা বাড়ছে।” নৌকার অনেক শ্রমিকই প্রতিদিন কাজ করে আয় করেন। নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় তাদের পরিবারে নেমে আসে চরম সংকট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কোনো সরকারি সহায়তা পায় না।
উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, এই উপজেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে জেলের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। এদের মধ্যে সরকারি নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৪৪ হাজার ৩১১ জন। সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে ১৭ হাজার ৫৬১জন। সমুদ্রগামী জেলে ট্রলার রয়েছে ১ হাজার ৩৬৫ টি।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু জানান, ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরান বন্ধের প্রকৃত সময়টি এখন। যেহেতু সরকার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, জেলেরা তা অবশ্যই পালন করতে হবে৷ যারা পালন না করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে
এছাড়াও জেলেদের জন্য নিষেধাজ্ঞা সময়ে ২৫ কেজি করে জেলে ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। তা সঠিকভাবে প্রকৃত জেলেদের মাঝে চলতি সপ্তাহের মধ্যে বন্টন করা হবে।