পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য ৭০৩টি স্বাস্থ্য সরঞ্জামসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের লক্ষ্যে একটি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৭৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। ক্রয় তালিকায় বিভিন্ন শ্রেণির পণ্য একত্রে থাকায় এটি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালার পরিপন্থি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের উদ্যোগ অনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতেই এমনভাবে কাজটি করা হয়ে থাকতে পারে। তবে অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। এ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার কার্যক্রম সম্পন্ন হলে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিরীক্ষা আপত্তির সম্মুখীন হতে পারেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলাও করতে পারে।
বিষয়টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দৃষ্টিগোচর করার জন্য গত ২ নভেম্বর একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিটি দিয়েছেন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মো. এনামুল ইসলাম। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২৭ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করা হয়।
ওই দরপত্রে ৭০৩টি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের সমন্বয়ে একটি একক প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে, যাতে রয়েছে ছুরি-কাঁচি, ঘড়ি, টেলিভিশন, এক্স-রে যন্ত্র, অ্যানেসথেশিয়া যন্ত্রসহ বিভিন্ন বিভাগের যন্ত্রপাতি। চিঠিতে আরও বলা হয়, প্যাকেজটিতে কারিগরি নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়েছে নিম্নমানের স্পেসিফিকেশন দিয়ে। যদিও কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এফডিএ বা সিই সনদ চাওয়া হয়েছে, তবুও একাধিক আইটেমে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও মডেলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে পিপিআর-২০২৫-এর পরিপন্থি।
এ ছাড়া পাঁচ বছরের পরিবর্তে মাত্র দুই বছরের ওয়ারেন্টি চাওয়া হয়েছে এবং উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনপত্রের পরিবর্তে স্থানীয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে, যা মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। এর আগে একই ধরনের একাধিক ক্রয়ে নিম্নমানের যন্ত্রে ইউরোপ ও আমেরিকার নামি প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ও সিল ব্যবহার করা হয়েছিল।
পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মালামাল গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ৭০৩টি আইটেম সরবরাহে বাংলাদেশের কোনো একটি প্রতিষ্ঠান এককভাবে দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
ফলে এটি প্রতিযোগিতাহীন ও একচেটিয়া দরপত্রে পরিণত হবে এবং সরকারের বিপুল অর্থের অপচয় ঘটবে। এমনকি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলেও চিঠিতে অভিযোগ করা হয়। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ প্রদান করে।
চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্যাকেজটিকে প্রয়োজনীয় বিভাগ ও ব্যবহারের ভিত্তিতে পিপিআর-২০২৫ অনুযায়ী বিভিন্ন লটে ভাগ করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করার জন্য, যাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং অপচয় রোধ সম্ভব হয়।
চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, উপদেষ্টার একান্ত সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাফর এবং সিপিটিইউর মহাপরিচালকের কাছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উন্নয়ন বাজেটের আওতায় আহ্বান করা এ দরপত্রের প্যাকেজের নাম ‘পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়’। প্রকিউরমেন্ট এন্টিটি কার্যালয় হচ্ছে ‘মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প, পটুয়াখালী’।
ক্রয়কারী কর্মকর্তার নাম এস এম কবির হোসেন। এ দরপত্রে একক প্যাকেজে ৭৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকার সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে রয়েছে— চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, অপটিক্যাল ও নির্ভুল যন্ত্র, ঘড়ি, ওষুধ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাসামগ্রী, চিত্র গ্রহণ যন্ত্রপাতি, হেমাটোলজিক্যালসামগ্রী, থেরাপি, অপারেটিং প্রযুক্তি, অ্যানেসথেশিয়া ও পুনরুজ্জীবন, কার্যকরী সহায়তাসামগ্রী ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম।
দরপত্রের মূল্যায়ন হওয়ার কথা ১৬ নভেম্বর। ক্রয় তালিকায় দেখা গেছে, একই লটে সিসিইউ বেড, কার্ডিয়াক মনিটর, হিমোডায়ালাইসিস যন্ত্র, পেশেন্ট মনিটর, পেশেন্ট টেবিলের পাশাপাশি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, এয়ার কুলার ও জেনারেটরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ডা. এস এম কবির হোসেনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ গেলে তারাই বিষয়টি দেখবেন। মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে তাকে কিছু জানানো হয়নি বলেও জানান।
পিপিআর লঙ্ঘন করে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদকের প্রশ্ন বুঝতে পারছেন না বলে জানান এবং নামাজের সময় উল্লেখ করে আর কথা বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সাইদুর রহমান জানান, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছে।
