মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক তিন শতাধিক আলোকচিত্র, বই, স্মরণিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কাঠের তৈরি বন্দুক (ভাঙা), পোশাক, রান্নার পাতিলসহ নানান জিনিসপত্র সংরক্ষিত ছিল বরগুনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্ব বরগুনায় স্থাপিত মোগল আমলের ঐতিহাসিক শাহি মসজিদ এবং পাশের পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের ঐতিহাসিক মজিদবাড়িয়া মসজিদে ব্যবহৃত ইটপাথরের অংশ রাখা হয় এই জাদুঘরে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সেখানে হামলার পর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে খালি কক্ষ তালাবদ্ধ পড়ে আছে। লুট হওয়া সামগ্রী ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েও কাজ হয়নি। জানা গেছে, নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বরগুনায় ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসভিত্তিক বেশ কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়।
পর্যায়ক্রমে এটি জেলা প্রশাসনের আয়োজিত জাতীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনের নিচতলার একটি কক্ষে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর এটিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।
এর পর থেকে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন। বরগুনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী চিত্তরঞ্জন শীল জানান, ১৯৮৫ কিংবা ’৮৬ সালের দিকে স্থানীয় কয়েক সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী জেলার মুক্তিযুদ্ধ ও প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু ছবি সংগ্রহ করে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। পরে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় প্রশাসন, এলাকার রোভার স্কাউট ও রেড ক্রিসেন্ট সদস্যরা এ উদ্যোগে সহায়তা করেন।
জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় সরকারে এলে বরগুনার এই কর্মসূচিতে সহযোগিতা করে। একটা সময় এ উদ্যোগ বিভিন্ন জাতীয় দিবসের কর্মসূচির অংশ হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন শীল জানান, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও স্থানীয় নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বিভিন্ন বই, প্রাচীন ও বর্তমান প্রদর্শনযোগ্য দলিলপত্র এখানে সংরক্ষণ করা হয়। কাজটি চলমান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াত, কৃষক-প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের দলিল সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
এ ছাড়া এখানে ইতিহাসভিত্তিক দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র ছিল। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পাশাপাশি ছিল সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বেতাগী শাহি মসজিদ ও মজিদবাড়িয়ার ঐতিহাসিক মসজিদের ইট, ছবি, বেতাগী কাউনিয়ার পার্বতী রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের নির্মিত ঐতিহাসিক মন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন, পুরোনো রেডিও এবং টেলিভিশন ছিল।
ছিল ১৯৯০ সালে তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙ্গায় ৪৮ ফুট দৈর্ঘ্যের তিমি মাছের হাড়, বিভিন্ন দেশের হাজার খানেক ধাতব ও কাগজের মুদ্রা। জাদুঘরে হামলার বর্ণনা দিয়ে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা কক্ষের প্রতিটি কাচঘেরা টেবিল ও সংরক্ষণ করা উপকরণ ভেঙে ফেলে। অনেক উপকরণ লুট করে।
বেশ কিছু বই-দলিলপত্র বাইরে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হয়। জাদুঘরে ব্যবহৃত মাইকও ভেঙে ফেলা হয়। অবশিষ্ট জিনিসপত্র যে যেভাবে পারে নিয়ে যায়। এর তিন দিন পর ঘটনাস্থলে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি দল। জাদুঘরের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তারা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত লুটের মালপত্র ফেরত আসেনি।
বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক ইউসুপ মৃধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, যেন জাদুঘরটি ঠিকঠাক করা হয় এবং লুট হওয়া দলিলপত্র উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে জেলা প্রশাসক তাছলিমা আক্তারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলেননি। হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়েও তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
