এখন মহামারী করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি করার অন্যতম উপায় ভিটামিন সি যুক্ত ফল খাওয়া। পেয়ারা হতে পারে স্বল্প মূল্যে পাওয়া সেই সুস্বাদু ফল। কিন্তু এবছর এই মহামারীতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পেয়ারার ন্যায্য মূল্য পাবেন কিনা সেটা নিয়েই চিন্তিত।
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানায় রয়েছে উপমহাদেশের সুস্বাদু বৃহৎ পেয়ারাবাগান। বাংলার আপেল নামে খ্যাত এ পেয়ারা আটঘর, কুড়িয়ানা, আতা, ভীমরুলীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের পেয়ারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়।
প্রায় দুশো বছর আগে এ অঞ্চলের এক কৃষক ভারতের গয়া থেকে এর বীজ সংগ্রহ করে প্রথম সূচনা করেছিলেন এই রসালো ফলের আবাদ। তারপর তা ছড়িয়ে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। বর্ষার এই দিনই পেয়ারার মৌসুম। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পেয়ারা কিনতে আসেন পাইকারী ব্যবসায়ীগণ। আসেন দেশ বিদেশী বহু পর্যটক। প্রতিটি পেয়ারা বাগানে ঢুকতে হয় ছোটো ছোটো নৌকায়। যতদূরে চোখ যায় পেয়ারা বাগানের সবুজ অরণ্য। আর ডালে ডালে ঝুলে থাকা পেয়ারার অনবদ্য সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। পেয়ারা চাষীগন নৌকায় করে তাদের পেয়ারা নিয়ে হাজির হন কুড়িয়ানা বাজারে। দেশের নানান প্রান্তের মানুষের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে এই বাজার, আটঘর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুড়িয়ানা আর্য সম্মিলনী বিদ্যালয়, কুড়িয়ানা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পিকনিক এর আয়োজনে।
কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান জনপদের নাম আটঘর-কুড়িয়ানা। পেয়ারার জন্য দেশব্যাপী এর খ্যাতি। এজন্য গ্রামের নাম ছাপিয়ে এর পরিচিতি পেয়ারার গ্রাম বলে। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী থানা সদর থেকে ৮ কি.মি. পূর্ব দিকে এই গ্রামের অবস্থান। যেখানে মাইলের পর মাইল রয়েছে কেবল পেয়ারার বাগান। এখানের সিংহভাগ বাসিন্দার আয়ের একমাত্র উৎস এই পেয়ার। যা বাংলার আপেল বলে খ্যাত। পেয়ারার মৌসুমে এই জনপদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। দূরন্ত এলাকা থেকে পাইকার আসে। বরিশাল ছাপিয়ে ফরিদপুর হয়ে রাজধানীসহ দেশের অনান্য অঞ্চলেও পৌঁছে যায় এখানের পেয়ারা।
ফি বছরের ন্যায় এবারেও একই চিত্র বিরজমান এই জনপদে। অ্যানথ্রোকনোজ (ছিটরোগ) নেই মোটেও, ফলনভালো এবং দরও বেশ। তবে রমজান চলে আসায় কিছুটা শঙ্কিত এখানের চাষিরা। বিশেষ করে যারা বাগান সৃজনকালে ঋণ নিয়েছিলেন মহাজনের কাছ থেকে। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে এবারে বরিশাল বিভাগের ৩ উপজেলার প্রায় দুই হাজারাধিক পেয়ারা চাষী অনেকটা নিরুদ্বেগ দিন কাটাচ্ছেন।
উৎপত্তির কথা
কবে এই জনপদে পেয়ারার চাষ শুরু হয়েছিল তানিয়ে দুটি মিথ প্রচলিত এখানে। শ্রুতি অনুযায়ী তা প্রায় দুই শতাধিক বছর আগের কথা। তীর্থ করতে এখানের কোন একজন ভারতের বিহার রাজ্যের গয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে এই ফল দেখে চাষ সম্পর্কে অবগত হয়ে বীজ এনে বপন করেছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানাতে। গয়া থেকে আনা বীজবপন করে গাছ এবং গাছ থেকে ফল পাবার পর, এর নাম রাখা হয়েছিল গয়া। সেখান থেকে অপভ্রশং হয়ে স্থানীয়রা এখন এই ফলকে গইয়া নামে ডাকেন। উৎপত্তির অপর কাহিনী সম্পর্কে আটঘর গ্রামের প্রবীণ পেয়ারা চাষী নিখিল মন্ডল জানালেন, আন্দাকুল গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল কাশীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সর্বপ্রথম তিনিই পেয়ারার বীজ নিয়ে আসেন এই এলাকায়। সেই বীজ থেকে যেসব গাছ উৎপন্ন হয়েছে এবং ঐ গাছে উৎপাদিত পেয়ারা এখনো পূণ্যমন্ডলী পেয়ারা নামে পরিচিতি। এই পেয়ারাটির গায়ে কমলালেবুর মত শির আঁকা আছে। খেতে বেশ সুস্বাদু, ভেতরে লালচে ধরণের এবং সুগন্ধিযুক্ত। এই হিসেব অনুযায়ী প্রায় পৌঁনে দুইশ বছরের কাছাকাছি হতে পারে এখানের পেয়ারা চাষের বয়স। পূণ্যচন্দ্র মন্ডলের নাতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নির্মল চন্দ্র মন্ডল(৮০) জানালেন, তার পিতার লাগানো শতাধিক বছরের পুরানো বাগান এখনো বিদ্যমান।
যেভাবে হয় পেয়ারার চাষ
সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পেয়ারা চাষ হয়ে থাকে। বীজ থেকে চারা উৎপন্ন করে কান্দি কেটে আট হাত দূরত্বে, একত্রে দুটো করে চারা লাগানোহয়। তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল ধরে। এই গাছ একশো থেকে সোয়াশো বছর বেঁচে থাকে এবং মুত্যুর আগ পর্যন্ত ফল দেয়। প্রতি বছর দুই বার করে বাগান নিড়াতে হয়। অগ্রহায়ণ পৌষমাসে মাটির প্রলেপ দিতে হয় সব কান্দিতে। ফাল্গুন মাসের দখিণা বাতাস বহার সাথে সাথে গাছে নতুন পাতা গজাতে থাকে। ফাল্গুন এবং চৈত্র এই দুই মাসে ফুল থেকে ফল বের হয়। পহেলা শ্রাবণ থেকে পূর্ণাঙ্গ ফল পাড়তে শুরু করেন চাষীরা। শ্রাবণ মাসের পুরোটা সময় প্রতিদিনই পেয়ারা সংগ্রহ করতে পারেন। বিশেষ করে পুরানো গাছের ফুল দেরিতে আসে বলে ফলও দেরিতে হয়। তবে পুরানো গাছের পেয়ারা চারা গাছের পেয়ারার চেয়ে বেশী সুস্বাদু হয়।
বর্তমানে বানারীপাড়া উপজেলার নরেরকাঠি, সৈয়দকাঠি এবং করিবকাঠিতে ১৩ হেক্টর জমিতে; ঝালকাঠী সদর উপজেলার শতদশকাঠি, ভিমরুলী, কাপুরকাঠি মিলিয়ে ২৮ হেক্টর জমিতে এবং স্বরূপকাঠি উপজেলায় পেয়ারা চাষ হয় ৭০৩ হেক্টর জমিতে। স্বরূপকাঠি উপজেলার পেয়ারা বাগানকে আবার ৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। কুড়িয়ানাতে ২৮৯ হেক্টর, ধলহার ২৬০ হেক্টর, গণপতিকাঠি ৬১ হেক্টর, মাদ্রায় ৪০ হেক্টর, মুসলিমপাড়ায় ৪২ হেক্টর এবং জলাবাড়িতে ১১ হেক্টর জমিতে পেয়ার চাষ হয়ে থাকে।