গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য লালন ও ধারণ করে চলা ২২৬ তম সূর্যমণি মেলা শুরু হতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ১৮ ফেব্রুয়ারী বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বেতাল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী ২২৬ তম সূর্য পুজা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে মাসব্যাপী সূর্যমণি মেলার আয়োজন করেন পূজা ও মেলা কমিটি। বানারীপাড়ায় সূর্য পুজার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণির মেলা।
মেলা কমিটির সভাপতি বাদল কৃষ্ণ সাহা জানান সূর্য পুজার মাধ্যদিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মেলা শুরু হবে। তবে ভক্তরা মেলা চলাকালীন যে কোনো সময়ে পুজা দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, প্রশাসনের কাছ থেকে এখনও মেলার আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাওয়া যায়নি। তবে তারা খুব দ্রুতই অনুমতি পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এবার মেলায় থাকতে পারে বহু ধরণের দোকান। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় থাকে লক্ষণ দাস সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, ভাগ্য পরীক্ষা, নাগর দোলা, কসমেটিকস, বাশ, বেত, লোহা, মাটি ও কাঠের আসবাপত্রের দোকান, রয়েছে মিষ্টি, চটপটি, চানাচুর, ফুসকা, মনখুশি, ঘুঘনি ও গরম গরম জিলেপী।
মেলার খাবারের মধ্যে মূল আকর্ষণ হচ্ছে বাগেরহাটের এক কেজি ওজনের একেকটি মিষ্টি। এসব দোকান ছাড়াও মেলায় বিভিন্ন ধরনের রেষ্টুরেন্ট, ফল ও ফুলের দোকান বসেছে।
সাংসারিক প্রয়োজনীয় অনেক দোকানের সমাহারও হয় এই মেলায়। এ মেলাকে ঘিরে শিশু, কিশোর ও কিশোরীরা সারা বছর ধরে পয়সা জমায়। তাদের পছন্দের জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য।
মেলা প্রসঙ্গে মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ধ্রুব লাল সাহা জানান মেলায় খুবই সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে।
মেলায় বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, গোপালগঞ্জ জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার মানুষ দোকান নিয়ে আসেন।
এছাড়াও এই মেলাকে ঘিরে বরিশালের বানাড়ীপাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, মুলাদী, বাখেরগঞ্জ, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, কাউখালি, ঝালকাঠির সদর, নলছিটিসহ অনেক এলাকা থেকে দর্শনার্থী ও পুজারী (ভক্তরা) আসেন।
মেলা চলাকালীন সময় এসব এলাকার ঘরে ঘরে আয়িত্ব স্বজনরা আসেন। তাদের আগমনে যেন সবার মাঝে মিলন মেলার প্রতিফলন ঘটে।
স্থানীয়রা মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানান ২২৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ইতিহাসটাও বেশ বৈচিত্র্যময়। বর্তমান সূর্যমণি মেলার কোল ঘেঁষে যাওয়া ছোট্ট খালটি এক সময় ছিলো বেশ বড় খাল।
চলাচল করত বড় বড় নৌকা ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা। তার কোল ঘেঁষে যে চরটি ছিলো (মেলা প্রাঙ্গণ) সেখানে গঙ্গু সরকারের চাষিরা চাষ করতে গেলে লাঙলের ফলা আটকে যায়।
পরে ওই স্থানে খুঁড়ে পাওয়া যায় সূর্য দেবের এক বিশাল আকারের মূর্তি। যার উচ্চতা ছিলো চার ফুট ও পাশে ছিলো প্রায় দুই ফুট ওজনে প্রায় চার মণের মত যেটি ছিলো মুল্যবান কষ্টিপাথরের প্রতিমা।
স্থানীয়রা আরও জানান খুঁড়ে ওঠানোর সময় প্রতিমাটির এক কোনায় কিছু জায়গা ভেঙে যায়। কিছুদিন পরে গঙ্গু সরকারের মা স্বপ্ন দেখেন প্রতিমাটি দিয়ে সূর্য পুজা দেয়ার, সেই থেকে মাঘী পূর্নিমার শুক্লা তিথির সপ্তমীতে শুরু হয় সূর্য দেবের পুজা। সেই থেকেই ওই স্থানে বসে ঐতিহ্যবাহী সূর্যমণির মেলা।
প্রথমে সূর্য পুজা উপলক্ষে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসতো ছোট আকারে একটি মেলা। তখনকার সময়ে কোন রকমের ছাপড়াঘরে পুজা হতো।
ওই সময়ে মূল্যবান প্রতিমাটি কে বা কাহারা নিয়ে যায়। তবে বর্তমানে বেশ বড় আকারে রূপান্তরিত হয়েছে সূর্য মন্দিরটি। মেলাও চলে মাসব্যপী।
ওই সময়ে গঙ্গু সরকার ও তার পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক ছিলো মৃত চেরাগ আলী মোল্লার পরিবারের সাথে। চেরাগআলী মোল্লা ছিলো মৃত খবির উদ্দিন মোল্লার পিতা।
তবে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় গঙ্গু সরকার তার পরিবার নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সময় স্থানীয় ভট্টাচার্য পরিবারকে সূর্য পুজা ও মেলা আয়োজনের অনুরোধ করে যান।
ওই সময়ে চেরাগ আলী মোল্লার পরিবার সংখ্যালুঘুদের পাশে থাকতো বিদায় গঙ্গু সরকার তাদের সকল সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে মোল্লা পরিবারকে দিয়ে সকল সংখ্যালঘু এবং বেতাল গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের পাশে থাকারও অনুরোধ করেন।
তারপর থেকে সূর্যপুজা ও মেলা আয়োজন অনেক বাধা-বিপত্তি আসে। যা পর্যায় ক্রমে মোল্লা পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে দাঁড়িয়ে সমাধান করেন।
উল্লেখ্য, মোল্লা বংশোদ্ভূত কেউ কোনদিন মেলা কমিটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। স্বাধীনতার পর পর সময়ে সূর্য দেবের প্রতিমাটি চুরি হয়ে যায় যদিও তারপরে মৃত খবির উদ্দিন মোল্লা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও প্রতিমাটির কোন হদিস করতে পারেননি। পরে জানা যায়, সূর্য পুজা বিরোধী লোকজনরা প্রতিমাটি চুরি করে নিয়ে যায়।
পুজা ও মেলা আয়োজন কমিটি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন শত শত বছর ধরে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য লালন করা সুর্যমণি মেলা আয়োজন করতে তারা সরকারিভাবে অনুমতি পাবেন।