বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই অনুয়ায়ী বর্তমানে সবস্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। আগামী ১১ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল ভিত্তি হচ্ছে এর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হবেন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির রাজনৈতিক পরিচয় এবং যোগ্যতা তার দায়িত্বপালনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রকার নাগরিক ও সরকারি সুবিধা আইনগত কাঠামোতে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশের সময়ে চৌকিদারি আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলর প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের খুবই প্রাচীন স্তর এবং উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন- সবই এসেছে অনেক পরে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তৃণমূলের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং একান্ত নাগরিক সুবিধাবলি দেয়া হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।
স্থানীয় সরকারের কনসেপ্টই হচ্ছে সামাজিকভাবে সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত ব্যক্তি হবেন এর প্রতিনিধি, সে কারণে ব্রিটিশ আমল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নাগরিকদের চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। হাল আমলে জন্মনিবন্ধন, উত্তরাধিকার সার্টিফিকেটসহ অনেক কিছু স্থানীয় চেয়ারম্যান দিয়ে আসছেন। গ্রাম্য আদালতের প্রধান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এখানেও প্রয়োজন রাজনীতি-নিরপেক্ষ ব্যক্তি। দলীয়ভাবে নির্বাচিত ব্যক্তি বিচারক হিসেবে নিরপেক্ষ থাকবেন তার গ্যারান্টি নেই। স্থানীয় সরকারে রাজনীতি যুক্ত করার ফলে এর মূল ভিত্তিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। স্থানীয় সরকারের মূল কাজ হুমকির মধ্যে পড়েছে।
রাজনৈতিকভাবে কোনো ব্যক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য স্থানীয় সরকারে তা অবান্তর, দরকার তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ থাকতেই হবে যাতে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সুযোগ না পান। মনে করেন এরশাদের মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যদি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দেন, ইউপি চেয়ারম্যানের সুযোগ রয়েছে রাজনৈতিক কারণে তাকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার বা তালাক কার্যকর না করে হয়রানি করার।
ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য, টেস্ট রিলিফ, দুর্যোগকালে ত্রাণের ব্যবস্থা, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা দেয়া হচ্ছে। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও পরিষদের। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর হয়েছে এর মাধ্যমে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহ করা বা সার-বীজ বিলি করার দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের। এসব কাজে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করার উদ্দেশ্যই ছিল যাতে নাগরিকরা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে চেয়ারম্যান বা মেম্বার দ্বারা বঞ্চনার শিকার না হয়।
বর্তমান চার হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন পরিষদের সিংহভাগ চেয়ারম্যান একাধারে ইউনিয়ন বা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা, আবার ইউপি চেয়ারম্যানও। দল থেকে নির্বাচিত বলে দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে তার পক্ষে নিরপেক্ষভাবে সব নাগরিক সেবা দেয়া প্রায় অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলার তদারকি জেলা ম্যাজিট্রেট বা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। আর ফিল্ডে মূল কাজটি করেন সংশ্লিষ্ট থানা প্রশাসন। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব এখানে গুরুত্বহীন নয়। আগের দিনে বরং তারাই মূল কাজটি করতেন।
এখন কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাডার যদি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি ছিনতাইকারীকে, মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে থানার হাতে তুলে দেবেন নাকি নিজেই তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে যাবেন- সেটা একটি বড় প্রশ্ন। আবার থানার সঙ্গে যোগসাজশে অনেক জায়গায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নিজেই মাদকবাণিজ্য, চাঁদাবাজি করছেন- এমন খবরও পত্রিকায় আসে। রাজনৈতিক দলের কথিত নেতা থাকাকালেও তাই করতেন এরা।
অনেকস্থানে, বিশেষ করে শহরতলীর আশপাশের চেয়ারম্যানদের প্রধান ব্যবসা এখন জমির দালালি, অন্যের জমি দখল করা, ভূমিদস্যুদের হয়ে কাজ করা। এ কাজে তাদের অস্ত্র রাজনৈতিক পরিচয়। তারা থানাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী সহযোগিতা করবেন! ফলে একবাক্যে বলা যায় সাধারণ জনগণের কাছে নির্ভরযোগ্য জন প্রশাসন ব্যবস্থাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণে।
আইনগতভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনই রাজনৈতিকভাবে হওয়ার কথা, এর প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রশাসন ভেঙে পড়ায় এমপিকে এখন করতে হয় স্থানীয় প্রশাসনের কাজ। এদের সবার কাজ প্রদত্ত দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেউ আইনগত চ্যালেঞ্জ করলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন হুমকির মধ্যে পড়বে।
স্থানীয় সরকারকে দলীয়করণ সরকারের উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্যও বিব্রতকর। তাদের দলীয় রঙ দেয়ার সুযোগ রয়ে গেছে এবং দেয়াও হচ্ছে। মনে করেন কোনো এলাকায় নদীভাঙন, বন্যা বা অন্য কোনো কারণে বেশি সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে, সেখানে সব ইউনিয়নকে সমান বরাদ্দ দেয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান যদি বিরোধী দলের রাজনীতিক হন সংশ্লিষ্ট সরকারি আমলা বিরোধী দলের সঙ্গে তার দহরম-মহরম আছে এই রটনার ভয়ে তা দেবেন না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানেই সরকারদলীয় সমর্থকদের অলিখিত বাড়তি সুবিধা। তারপরও আগে ইউপি নির্বাচনে লড়তেন সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক এবং তাদের মধ্য থেকে জনপ্রিয়তা, সরকারি দলের আনুকূল্য মিলিয়ে যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত হতেন। ভোটকারচুপি হতো, কিন্তু ডাকাতি ছিল না। এরশাদ আমল থেকে ইউপি নির্বাচন ভোটডাকাতির দিকে চলে যায়। কেন্দ্রদখল, গুণ্ডা-হোন্ডা, ককটেল-বোমা দিয়ে নির্বাচনে বিজয় সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়ে। খালেদা জিয়ার ১৯৯১ সালের আমল থেকে ইউপি নির্বাচনে কারচুপি, কেন্দ্রদখল প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। জৌলুস হারাতে থাকে।
সর্বশেষ বর্তমান সরকারের আমলে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের ব্যবস্থার পর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে পতনের দিকে যাচ্ছে। আইনগত বাধা না থাকলেও দলমত নির্বিশেষে মানুষ যাদের ভালোবাসে এমন ভদ্রলোকরা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। কারণ তাদের জয়ী হওয়ার পথ অনেকটা রুদ্ধ এখন। দলীয় মনোনয়ন যারা পাবেন, তারাই নির্বাচিত হবেন—এটা এখন প্রতিষ্ঠিত। সরকার দলীয় প্রার্থীদের বেলায় এটা আরও সত্য।
স্থানীয় এমপিদের পছন্দের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান- পৌর মেয়র পদে মনোনয়ন পায়, অনেকের গ্রামের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও শহর থেকে গিয়ে চেয়ারম্যান-মেয়র হচ্ছেন। যাদের টাকা এবং গুণ্ডা আছে তারাই এমপির আনুকূল্যে নির্বাচনী মনোনয়ন পান। অনেকস্থানে আইয়ুব খানের বেসিক গণতন্ত্র স্টাইলে দলীয় কাউন্সিলরদের ভোটে প্রার্থী নির্ধারিত হন। দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব কাউন্সিলরকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে চেয়ারম্যান-মেয়র পদপ্রার্থীদের।
যখন ইউনিয়ন পরিষদকে দলীয়করণ করা হচ্ছিল তখনও আমি এর বিরুদ্ধে লিখেছি। টকশোর সাবজেক্ট করেছি এবং সরকারকে বলেছি দেশ শাসনের এই নিম্নস্তরকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখুন। নয়তো সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আজ তা-ই হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় শুধু নয়, ঘরে ঘরে দলীয় ভিত্তিতে বিভক্তি। সমাজপতি হওয়ার জন্য দলীয় পরিচয়টাই বড় হয়েছে। গুণ্ডা, অশিক্ষিতরা সমাজের নেতৃত্ব নিয়েছে, সমাজপতিরা বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামভিত্তিক সমাজ কাঠামোর পুরোটাই ভেঙে গেছে। দলীয়করণের এই পরিণতিটা সরকার এবং আমলাতন্ত্রের উচ্চস্তরে বসা লোক এখনও বুঝছেন কিনা তা জানি না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করব- অন্তত যেন ইউনিয়ন পরিষদ দলীয়করণের ব্যবস্থাটি বাতিল করে দেন। কারণ যিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তিনিই তার এলাকার রাজনৈতিক দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা বড় কোনো নেতা। একদিকে দলীয় ক্ষমতা অন্যদিকে সরকারের দেয়া প্রশাসনিক ক্ষমতা—দুটোই তার হাতে। দুর্নীতি করে তা আড়াল করার সুযোগও তাই বেশি, জবাবদিহির পরিমাণ কম। তার রাজনৈতিক দলকেও তার কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই গাইতে হয়। আর যদি সামাল দিতে না পারে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা ‘চোরের কোনো রাজনৈতিক দল নেই’ বলে যে বাণী দেয়, মানুষ এখন তা বিশ্বাস করে না।