চীনের জেজ্যাং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারদের গড়া প্রতিষ্ঠান ডিপসিক। মাত্র দুই বছর আগে যাত্রা শুরু করে এটি।
গত ডিসেম্বরেই পশ্চিমা বিভিন্ন এআইয়ের সমকক্ষ হিসেবে প্রমাণ করেছিল আর১-এর আগের মডেল ডিপসিক ভি৩। প্রগ্রামিং, তথ্য বিশ্লেষণ, লেখালেখি এবং অঙ্কের জটিল সমস্যা সমাধানের মতো বিভিন্ন বেঞ্চমার্কে সেটি অনেকটা এগিয়ে ছিল। আরো শক্তিশালী নতুন আর১ মডেলটি প্রকাশিত হয়েছে ২০ জানুয়ারি। ব্যবহারকারীরা নতুন মডেলটি পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েই রীতিমতো অবাক! অনেকেই মন্তব্য করেছে, অবশেষে হাজির হয়েছে চ্যাটজিপিটির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী।
এআই ব্যবহারের খরচ পরিমাপ করা হয় টোকেন হিসেবে। প্রতি ১০ লাখ টোকেনের জন্য ওপেনএআই নিচ্ছে ১৫ ডলার, সেখানে ডিপসিক নিচ্ছে মাত্র দুই ডলার ১৯ সেন্ট। যেসব প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে এআই ব্যবহার করে, তারা দ্রুতই ওপেনএআই বাদ দিয়ে ডিপসিক ব্যবহারে ঝুঁকতে পারে।
ডিপসিক যদি ৯৫ শতাংশ কম খরচে এআই সেবা দিতে পারে, তাইলে পশ্চিমা এআই নির্মাতাদের আয় কমে যাবে—এমন ধারণা করে অনেক বিনিয়োগকারী এআই চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। ফলে ৬০ হাজার কোটি ডলার বাজারমূল্য হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চ দরপতনের ইতিহাস গড়েছে এনভিডিয়ার শেয়ার। দরপতন হয়েছে গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট এবং ওপেনএআইয়ের শেয়ারেরও। এক ডিপসিকে পতন ঘটিয়েছে এক লাখ কোটি ডলার বাজার মূল্যের বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে।
এআই মডেলগুলোকে সম্পূর্ণ ওপেনসোর্স করেছে ডিপসিক। চীনা প্রযুক্তির বিষয়ে পশ্চিমাদের অবিশ্বাস কমানোই তাদের লক্ষ্য। সে জন্যই মডেলের পুরো কোড নিজে পরীক্ষা করার সুযোগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি যে কেউ চাইলে ওপেনসোর্স মডেলগুলো ডাউনলোড করে নিজেদের পিসিতে চালাতে পারবে। ওপেনএআইয়ের মতো ক্লাউডসেবার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে না। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এর মধ্যেই নিজস্ব ডিপসিক সেবা চালুর জন্য কাজ করছে। এতে করে এআই বাজারে থাকবে না গুগল, মেটা ও ওপেনএআইয়ের অলিগার্কি।
তবে ডিপসিকের দাবিগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেক এআই বিশেষজ্ঞ। স্কেল এআই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্ডার ওয়াং বলেছেন, শুধু এইচ৮০০ চিপ ব্যবহার করে এতটা চমৎকার এআই তৈরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্তত ৫০ হাজার এইচ১০০ চিপ অবৈধভাবে আমদানি করেছে ডিপসিক। তিনি এও বলেছেন, ডিপসিকের আর১ মডেলের অনেকটা অংশ ওপেনএআইয়ের জিপিটি ও১ থেকে নকল করা। নিজস্ব সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিট তৈরি না করে ওপেনএআইয়ের এসডিকে ব্যবহার করাকে ট্রোজান হর্স উপাধি দিয়েছেন অনেক এআই গবেষক। এতে করে বর্তমান ওপেনএআইয়ের সেবা ব্যবহারকারীরা শুধু এক লাইন কোড পরিবর্তন করেই ডিপসিক ব্যবহার শুরু করতে পারবে। ফলে ওপেনএআইয়ের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা ডিপসিকের জন্য খুবই সহজ। পশ্চিমা প্রযুক্তি নকল করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে বাজার ধরার জন্য চীনাদের দুর্নাম আছে আগে থেকেই, ডিপসিকও হাঁটছে একই পথে। একাধিক ব্লগে এমনটাই লিখেছেন বেশ কিছু এআই গবেষক ও বাজার বিশেষজ্ঞ।
বর্তমানে অ্যাপল ও গুগল অ্যাপস্টোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডিপসিক। বিপুল পরিমাণ নতুন ব্যবহারকারী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ডিপসিকের সার্ভার। তাদের দাবি, এর মধ্যেই হ্যাকাররা তাদের সার্ভারে চালাচ্ছে সাইবার হামলা। ব্যবহারকারীরা ডিপসিকের জ্ঞানের বিভিন্ন সীমাবদ্ধা নিয়ে হাসি-তামাশাও করছে, সেসব মিম বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। এ বিষয়ে ডিপসিকের মুখপাত্র তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব আইন আছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে তা মেনে চলতে হয়। ডিপসিক যেহেতু চীনা প্রতিষ্ঠান, অবশ্যই তাদের এআই চীনা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
ব্যবহারকারীদের তথ্য অরক্ষিত ডেটাবেইসে রাখায় এর মধ্যেই শুরু হয়েছে কঠিন সমালোচনা। সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইজ আবিষ্কার করেছে ডিপসিকের একটি ক্লিকহাউস ডেটাবেসের নিয়ন্ত্রণ যে কেউ চাইলেই নিয়ে নিতে পারবে। সমস্যাটি দ্রুতই সমাধান করেছে ডিপসিক, তবে তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ কাটছে না। ডিপসিক কিভাবে, কোথায় গ্রাহকদের তথ্য ব্যবহার করছে তা জানতে চেয়ে আশানুরূপ উত্তর না পাওয়ায় এআই সেবাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইতালির সরকার। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যান হতে পারে ডিপসিক। তবে ডিপসিকের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিম এআই যুদ্ধ সবে শুরু, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।