একই মাঠে মসজিদ ও মন্দির। এক পাশে আতরের সুঘ্রাণ, অন্যপাশে ধূপকাঠি। এক পাশে নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা, অন্য পাশে পূজা দিচ্ছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এভাবেই অর্ধ শতাব্দী ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়িয়ে যাচ্ছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের আধুনা এলাকার শেনেরহাট বাজার জামে মসজিদ ও সার্বজনীন দুর্গামন্দির।
ধর্ম ভিন্ন হলেও দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির অটুট বন্ধন দীর্ঘদিনের। সরেজমিন দেখা গেছে, একই মাঠের ১০ ফুট দূরত্বে মসজিদ-মন্দিরের অবস্থান। প্রতিবছরের মতো এবছরও জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে ওই স্থানে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরোধ তো দূরে থাক, স্থানীয় মুসলিম নর-নারীরা প্রতিবেশী হিন্দুদের পূজা উদযাপনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জানা গেছে, দুই সম্প্রদায়ের আলাদা ধর্মীয় উপাসনালয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যে প্রায় ৫০ বছর ধরে চলছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দুর্গাপূজার সময় মন্দির থেকে ভেসে আসে ঢাকঢোল, উলু, শঙ্খধ্বনি আর সন্ধ্যায় হয় আরতি অনুষ্ঠান। তবে মসজিদে আজান শুরু হলেই নীরবতা বজায় রাখেন পূজারি ও ভক্তরা। নামাজ শেষ হলেই আবার শুরু হয় পূজার্চনা।
মন্দিরের পূজারি স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, মসজিদে আজান শুরু হলেই আমরা পুরো অনুষ্ঠানের বিরতি দিই। নামাজ শেষে আবার আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এখানে কেউ কারও জন্য বিরক্তির কারণ হননি কখনই; বরং দুই ধর্মের অনুসারীরা আগলে রেখেছেন তাদের এ পবিত্র দুটি স্থান। স্থানীয় বাসিন্দা মাকসুদ মৃধা বলেন, এখানে সবাই মিলেমিশে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার পালন করছেন। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এমনটিই করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই তারা পূজা দেখতে মণ্ডপে যান। আবার ঈদে কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানেও আসেন হিন্দু প্রতিবেশীরা। মন্দির কমিটির সভাপতি শংকর চন্দ্র দাস বলেন, ১৯৭২ সালে আধুনা শেনের বাড়ি সার্বজনীন দুর্গামন্দির স্থাপন করা হয়। পরে একই মাঠে আধুনা জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের মাত্র ১০ ফুট দূরত্বে অবস্থিত জামে মসজিদে মুসলমান ধর্মের লোকজন তাদের ধর্ম পালন করে আসছেন। আমরা মন্দিরে আমাদের ধর্ম পালন করে আসছি।
তিনি আরও বলেন, মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি হলেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এভাবেই ধরে রেখেছে সম্প্রীতির বন্ধন, সেই বন্ধন গড়ে তুলেছে ঐতিহ্য। চলছে মুসলিম-হিন্দু ধর্মীয় নানা কর্ম আর আনুষ্ঠানিকতা। এখানে কারও মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষের কোনো চিহ্ন নেই। আধুনা শেনের বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা কামরুল ইসলাম বলেন, এখানে ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।
মসজিদে আজান হলেই হিন্দু ভাইয়েরা ঢাকঢোলের আওয়াজ বন্ধ রাখেন। আজান-নামাজ শেষ হলেই আবার তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। বছরের পর বছর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে এখানে যে যার ধর্ম পালন করেন। কেউ কারও প্রতি বিন্দুমাত্র বিরক্তির কারণ হয়নি।
গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইব্রাহীম বলেন, উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের আধুনা গ্রামের একই স্থানে মসজিদ-মন্দির দীর্ঘ বছর ধরে ওই এলাকায় সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, আমরা এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থাই চাই আমরা। যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলেমিশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করবে।