More

    কর্মহীন দক্ষিণের সাড়ে ৪ লাখ জেলে, কিস্তি আর দাদন নিয়ে চিন্তা

    অবশ্যই পরুন

    বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া চরের জেলে আলী হোসেন। ছয় সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। প্রতিদিন নদীতে মাছ শিকার করে যা আয়, তা দিয়েই টেনেটুনে চলছিল সংসার। মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে পড়েছেন তিনি। এখন একমাস সংসারের ব্যয়, সঙ্গে ঋণের কিস্তি আর দাদনদারের চাপে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

    শুধু আলী হোসেন নয়, তার মতো দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার সাড়ে চার লক্ষাধিক জেলের মাথায় এখন একই দুশ্চিন্তা।

    তারা বলছেন, আষাঢ় থেকে আশ্বিন ইলিশের প্রধান মৌসুম। এর মধ্যেই ৬৫ দিনের এবং পরে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। সঙ্গে বৈরী আবহাওয়া এবং নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ পাননি এবার। নিষেধাজ্ঞায় যে চাল পান তাতে সংসার চলে না। পরিবার নিয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন পার করতে হয়। তার ওপর ঋণের কিস্তি। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি নগদ অর্থের দাবি জানিয়েছেন জেলেরা।

    জেলে আলী হোসেন বলেন, ছয় সদস্যের সংসারে তিন বেলা খেতে দৈনিক আড়াই কেজি চাল প্রয়োজন। সরকার বরাদ্ধ দেয় মাত্র ২৫ কেজি। আমরা হাতে পাই ২০ কেজি। এই চাল দিয়ে সংসার চলে না। তাছাড়া যে চাল বরাদ্দ দিয়েছে তা কবে নাগাদ পাবেন তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জেলেদের বাধ্য হয়ে মাছ শিকারে যেতে হয়।

    পার্শ্ববর্তী হিজলা উপজেলার টুমচরের জেলে খালেক বেপারি বলেন, এবার মাছ পাইনি, তাই দাদনও শোধ করতে পারিনি। শোধ না করলে আগামী বৈশাখে নতুন দাদন পাব না।মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে। তখন থেকে ধীরে ধীরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল।

    তবে ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে-পরে ১১ দিন মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে গবেষণায় দেখা যায়, পূর্ণিমার পাশাপাশি অমাবস্যায়ও ইলিশ ডিম ছাড়ে। তাই পূর্ণিমা ও অমাবস্যা মিলিয়ে দেশে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়।

    এর অংশ হিসেবে ৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। আইন অমান্য করলে মৎস্য আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বেকার হয়ে পড়া জেলেদের প্রণোদনা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।

    বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় জেলের সংখ্যা সাড়ে চার লাখের বেশি। তাদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার সময় চাল পান ৩ লাখ ৪০ হাজার নিবন্ধিত জেলে। এর মধ্যে ভোলা জেলায় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৩৮ জন জেলে।

    এ ছাড়া বরিশাল জেলায় ৬৬ হাজার ৫২৪ জন, পটুয়াখালীতে ৬৯ হাজার ৪৩ জন, পিরোজপুরে ১৯ হাজার ২৫০ জন, বরগুনায় ৩৭ হাজার ৯৯৫ জন এবং ঝালকাঠি জেলায় ৩ হাজার ৭৫০ জন নিবন্ধিত জেলে। এসব জেলের ভেতরে ৮ হাজার ৫০০ টন চাল বিতরণ করা হবে। প্রতি জেলে পাবেন ২৫ কেজি করে চাল।

    ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের জেলে ইব্রাহিম মাঝি ও ইদ্রিছ মাঝি বলেন, এ বছর নদীতে ইলিশের চরম খরা ছিল। নদীতে মাছ শিকারে গিয়ে অনেক সময় তীরে ফিরে মাছ বিক্রি করে দেখা যেত, তেলের টাকাও ওঠেনি। এতে করে আমাদের এলাকার জেলেরা চরম কষ্টে দিনপার করেছেন। এখন আবার মা ইলিশ রক্ষার জন্য টানা ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তবে আমাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে এনজিওগুলো যেন তাদের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখে।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩ অক্টোবর সন্ধ্যার পর থেকেই জেলেরা তাদের নৌকা ও ট্রলার নিয়ে তীরে ফেরেন। বাকিরা নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই গভীর রাতে মাছ ধরা ট্রলারগুলো ঘাটে নোঙর করেন। কেউ কেউ ট্রলার থেকে ইঞ্জিন খুলে বাড়িতে নিয়ে গেছেন। আবার অনেকে জাল এবং ট্রলার মেরামত শুরু করেছেন।

    ভোলার তুলাতুলি এলাকার জেলে ফিরোজ মাঝি ও আকবর মাঝি বলেন, এ বছর ভরা মৌসুমে আশানুরূপ ইলিশ পাইনি। সম্প্রতি মাছ ধরা শুরু হলেও নিষেধাজ্ঞা চলে এসেছে। তাই তারা গত শুক্রবার সন্ধ্যার পরই নদী থেকে ফিরে এসেছেন। যা মাছ পেয়েছেন, তা বিক্রি করে ভালো দাম পাননি।

    বরগুনা সদরের নলী এলাকার বাসিন্দা জেলে আব্দুর রব বলেন, এ বছর সাগরে আবহাওয়া খারাপ থাকায় ভালো মাছ পাইনি। এখন শুরু হয়েছে ২২ দিনের অবরোধ। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি আছে। এই কয়দিন দেনা করে এই কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

    পাথরঘাটার জেলে জলিল মাঝি বলেন, নিষেধাজ্ঞার ভেতরে অনেকেই অবৈধভাবে সাগরে যায়। আবার ভারতীয় জেলেরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। অবরোধ শেষে যখন সাগরে যাই তখন আর মাছ পাই না। সরকারের কাছে দাবি জানাই ভারতীয় জেলেরা যাতে ঢুকতে না পারে।

    শুধু মা ইলিশ রক্ষা করলেই হবে না, জেলেদের জীবিকার দিকেও নজর দিতে হবে বলে জানিয়েছেন পাথরঘাটা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে যে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। চালের পাশাপাশি নগদ অর্থও দিতে হবে। সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে বলে আমরা আশাবাদী। না হলে শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মা ইলিশ রক্ষার অভিযান সফল করা যাবে না।

    মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কামরুল হাসান, জানিয়েছেন, এরই মধ্যে জেলেদের মাঝে বরাদ্দের চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা শুরুর পরদিন শনিবার পিরোজপুর ও মঠবাড়িয়ায় এবং রোববার বরিশাল, ঝালকাঠি এবং বরগুনা জেলায় জেলেদের মাঝে ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সব উপজেলায় কার্ডধারিদের মাঝে চাল পৌঁছে যাবে বলে আশা করছি।

    তিনি বলেন, জেলেদের আর্থিক প্রণোদনার দাবির বিষয়টি আমি শুনেছি। মূলত, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। জেলেরা যে দাবিটা আমাদের কাছে জানাচ্ছেন সেটা যদি মন্ত্রণালয়ে, উপদেষ্টার কাছে লিখিতভাবে জানাতে পারতেন তবে সেটা নিয়ে তারা ভাবতে পারতেন।

    তবে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলেদের সার্বিক প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এতে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জেলেদেও কষ্ট যেমন দূর হবে, তেমনি ইলিশের উৎপাদন বাড়বে বলেন এই কর্মকর্তা।

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    অসুস্থতার নাটক সাজিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত এই দম্পতি

    বরগুনায় সাইবার প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত আন্তঃজেলা প্রতারক চক্রের তিন...