স্টাফ রিপোর্টার:আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর চারটি গুরুত্বপূর্ণ আসনের মধ্যে ১১২,পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা-গলাচিপা) সংসদীয় আসন। এ আসনের রাজনীতি সারাদেশে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
দুই হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সভাপতি হাসান মামুন এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ডাকসু ভিপি, নুরুল হক নুর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী করার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৯১ সাল থেকে আওয়ামীলীগ এই আসনে ভোটের মাঠে আধিপত্য ধরে রাখলেও ৫ ই আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এই আসনের পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন সম্ভাব্য এই দুই প্রার্থী।
বিএনপি ও গণ অধিকার পরিষদ জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে এ আসন থেকে কে হচ্ছেন প্রার্থী? নুরুল হক নুর না হাসান মামুন এমন কৌতুহল এ আসনের জনগণের মাঝে বিরাজ করছে।
একই সঙ্গে এ আসনে আলোচনায় রয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চল টিম সদস্য অধ্যাপক মু. শাহ আলম ও ইসলামী যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর প্রার্থী মাও. আবু বকর সিদ্দিক। অনেকের ধারণা ইসলামী দলগুলো একই প্লাটফর্মে জোট করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তারাও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারে।
তাছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী এ আসনে নির্বাচনে লড়বেন কিনা তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তারপরেও অত্র নির্বাচনি আসনের অনেকে মনে করেন নির্বাচনি সমীকরণের মারপ্যাঁচে ধানের শীষ বনাম ট্রাক এর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
এ বিষয়ে অনলাইন কিংবা অফলাইনে কথার লড়াইও বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।
এ আসনে মোট ভোটার ৩,৫২,২৬১ জন, যার মধ্যে পুরুষ ১,৭৭,১৫৪, নারী ১,৭৫,১০৫ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ২ জন ভোটার রয়েছেন। অতীতে আওয়ামী লীগের মরহুম আ.খ.ম জাহাঙ্গীর হোসাইন চারবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে বিএনপির মরহুম শাহজাহান খান বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হন। এছাড়া ২০০৮ সালে গোলাম মাওলা রনি এবং ২০১৮ ও ২০২৪ সালে এসএম শাহজাদা আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হন।
বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থী জননন্দিত নেতা হাসান মামুন ছাত্র রাজনীতিতে অগ্রগামী ভূমিকা রেখে বর্তমানে বেশ জোরালোভাবে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও পরে ছাত্রদল সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য। ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, তৃণমূল পর্যায়ে ও জাতীয় পর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা তাকে পটুয়াখালী-৩ আসনে ধানের শীষের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
দলের নেতা-কর্মীদের দাবি, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে হাসান মামুন এর হাত ধরে বর্তমানে এ আসনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি শক্ত অবস্থানে অবস্থান করছে। হাসান মামুন প্রশ্নে তারা এক এবং আপোশহীন। তাদের দাবি হাসান মামুন একদিনে তৈরি হয়নি। শিকড় থেকে শিখরে সে আজ অবস্থান করছেন।
সে কর্মী-বান্ধব এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণে গুণান্বিত। কেন্দ্র যদি হাসান মামুনকে মনোনয়ন প্রদান করে তাহলে তারা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও দেশনায়ক তারেক রহমানকে এ আসন উপহার দিতে পারবেন। তরুণ প্রজন্ম থেকে বয়স্ক ভোটার সকলের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন হাসান মামুন।
অন্যদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন, গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন। ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে জুলাই -২৪ এ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে ভিপি নুর সামনের সারির একজন অগ্রসৈনিক হিসেবে পরিচিত।
স্বৈরাচারী সরকার পতনে তাঁর ভুমিকা জাতীয় পর্যায়ে বিকল্পধারা এবং তরুণ সমাজের পরিবর্তনের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাদের দলের নেতা-কর্মীদের দাবি নুরুল হক নুর নির্যাতিত,- নিপীড়িত জাতীয় নেতা, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁকে তারা তাঁর নিজ এলাকা থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করবেন। ভোটারদের আলোচনায় তিনিও পিছিয়ে নেই। এলাকায়ও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ তাকে বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে দেখছে।
একদিকে হাসান মামুনের দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা, বিএনপির শক্তিশালী ভোট ব্যাংক ও সাধারণ জনগণ তথা নেতা-কর্মীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক। অন্যদিকে ভিপি নুরের জাতীয় পরিচিতি, তরুণদের আবেগ এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে সামনের সারির নেতৃত্বকে ভোটারদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক মু. শাহ আলম। তিনিও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দলটির নেতা-কর্মীদের দাবি, কোনো রকম কারচুপি বা কেন্দ্র দখল করা না হলে দক্ষিণের এই জনপথের অত্যন্ত যোগ্যতা সম্পন্ন জনপ্রিয়, নির্যাতিত নেতা অধ্যাপক মু. শাহ আলম এর বিজয় সুনিশ্চিত। তারা মনে করেন, সাম্য-ন্যায়, জনগণের অধিকার আদায় এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে জামায়াতে ইসলামী’র কোনো বিকল্প নেই।
জামায়াতে ইসলামী’র প্রতি ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন আছে বলেও মনে করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। তাছাড়া তাদের সাংগঠনিক তৎপরতাও বেশ জোড়ালো বলে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী মু. শাহ আলম এগিয়ে আছেন বলে মনে করছেন অনেকে। দলটির নেতা-কর্মীসহ অনেকে মনে করেন দেশে জাতীয় পার্টি, আওয়ামীলীগ, বিএনপি’র শাসনামলের পর একটিবার জামায়াত ক্ষমতায় আসলে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আমুল পরিবর্তন আসবে। দীর্ঘ বছর বড় ধরণের কর্মসূচি পালন করতে সমর্থ হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে জানান দলটির নেতা-কর্মীরা।
এছাড়া বরিশাল অঞ্চলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর অবস্থান মোটামুটি শক্তিশালী হওয়ায় এই আসনেরও তার ব্যতিক্রম নয়। দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তাদের কর্মী-সমর্থকদের ভোটব্যাংক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরণের শোডাউনের মাধ্যমেও তা প্রকাশ করেছেন। তাদের দলের নেতাকর্মীদের দাবি, ক্লিন ইমেজের নেতা, ইসলামী যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী মুফতী আবু বকর সিদ্দীক এ আসন থেকে নির্বাচিত হবেন। সাংগঠনিক দিক থেকে শক্ত অবস্থানে রয়েছে দলটি এমনটাই মনে করছেন দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা।
তবে ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে রাজনৈতিকভাবে তারাও এ আসনে শক্তিশালী হয়ে উঠবেন বলে মনে করছেন অনেকে।
এছাড়াও পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপি’র মনোনয়নের আলোচনায় আরো রয়েছেন সাবেক এমপি গোলাম মাওলা রনি ও সাবেক নির্যাতিত বিএনপি নেতা সাবেক সাংসদ প্রয়াত আলহাজ্ব মো. শাহজাহান খান এর পুত্র সাবেক জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শিপলু খান। বিএনপি’র একাংশ শিপলু খান এর পক্ষে মিছিল মিটিংসহ গলাচিপা-দশমিনা আসনে নানা দলীয় প্রোগ্রাম পালন করে আসছেন। তারাও শিপলু খান দলের মনোনয়ন পেয়ে এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন এমন প্রত্যাশা করছেন।
অপরদিকে আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি রাজনৈতিকভাবে নিজ এলাকায় তেমন সক্রিয় নেই তবে বিগত নির্বাচনগুলোতে চমক দেখিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এমনকি সাংসদও নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর সমর্থকরা মনে করছেন, তিনি তাঁর দল থেকে মনোনয়ন পেলে আবারো সাংসদ নির্বাচিত হবেন।
এ সব কিছুই মিলিয়ে পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা-গলাচিপা) আসনের নির্বাচনী হাওয়ায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক মারপ্যাচে কোন দল আসনটি লুফে নিতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অঞ্চলে নেতাদের শুধু জাতীয় পরিচিতি ও তরুণদের আবেগ মাঠের শক্তিকে পরাজিত করতে যথেষ্ট নয়। সাংগঠনিক তৎপরতা, জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা,স্থানীয় রাজনীতির সক্রিয় নেটওয়ার্ক এবং কর্মী-সমর্থকদের তৎপরতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের ফলাফল। তাঁদের মতে, বিগত প্রায় ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দশমিনা-গলাচিপা’র মানুষ বছরের পর বছর উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার এবং দৃশ্যমান তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসংস্থান ও নদীভাঙন প্রতিরোধ, সবক্ষেত্রেই এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, ধানের শীষের কান্ডারী হিসেবে হাসান মামুন বিজয়ী হলে দক্ষিণাঞ্চলের এই আসনে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। তবে অনেকে মনে করছেন সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর এ আসন থেকে নির্বাচিত হলে এ অঞ্চল দেশের মডেল হিসেবে উন্নীত হবে।
পটুয়াখালী-৩ আসনের এবারের নির্বাচন শুধু একটি ভোটযুদ্ধ নয়, এটি জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ সমীকরণের এক চমকপ্রদ প্রতিফলন ঘটবে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকবৃন্দ। তবে এই সমীকরণের সমাধান খুঁজতে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে পটুয়াখালী-৩ (দশমিনা-গলাচিপা) আসনের জনগণকে।