উপকূলের জেলেরা যখন ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে নামেন, তখন তাদের চোখে থাকে রোজগারের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধ্বংস করছে অবৈধ জালের ভয়ঙ্কর বিস্তার। চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন নামের জালের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে। কেবল মাছই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্রের ভবিষ্যৎ এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি।
এক সময় গ্রামের খাল-বিলে দেখা মিলত শত রকমের দেশীয় মাছ—পুঁটি, টেংরা, চিংড়ি, বাইন, কই, শিং, মাগুর, গজার। এসব ছিল খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এখন সেই খাল-বিলে চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন নামের জালে শেষ হয়ে যাচ্ছে মাছের প্রজাতি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের খাল-বিল ও ছোট জলাশয়ে স্থানীয়রা অবাধে এসব জাল ব্যবহার করছেন। বর্ষা মৌসুমে মাছের প্রজননের সময় এই জালের ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। ফলে দেশীয় মাছ ক্রমেই নিধন হচ্ছে। স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, চায়না দুয়ারি জালে সব ধরনের মাছ ধরা যায়। সহজে মাছ ধরার সুযোগ এবং কম দাম হওয়ার কারণে বর্তমানে অধিকাংশ জেলে এই জাল ব্যবহার করছেন। এছাড়া অনেক মৌসুমী মৎস্য শিকারিরাও এ জাল ব্যবহার করছেন।
‘বুচনা জাল’ এবং ‘চায়না দুয়ারি জাল’ পানির নিচে ছোট মাছ ছাড়ে না, ডিম ও পোনা ধ্বংস করে। ‘আটন জাল’ পুরো খাল বা বিল ঘিরে ধরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। এতে শুধু মাছ নয়, জলজ পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া এবং মাছের খাবারও জালে আটকে যায়। মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নের মম্বিপাড়া গ্রামের জেলে আবুল কালাম বলেন, একটা খালে ২ থেকে ৩ বার আটন টানলেই সেখানে আর মাছ থাকে না।
যে মাছগুলো একসময় শিশু-কিশোররা বাঁশের ছিপে ধরে আনন্দ পেত, সেগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে সস্তা লাভের ফাঁদে। ওয়ার্ল্ডফিসের গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, দেশের গ্রামীণ জলাশয়, খাল, বিল ও পুকুরে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এ ফাঁস এত ছোট যে মাছের পোনা থেকে পোকামাকড় পর্যন্ত আটকে যায়।
প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব জাল জব্দ ও ধ্বংস করা প্রয়োজন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের ৩০টির বেশি দেশীয় মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এর অন্যতম কারণ হলো অবৈধ জালের ব্যবহার। ২০১৫ সালের মৎস্য সংরক্ষণ বিধিমালায় ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের কম ফাঁসযুক্ত জাল নিষিদ্ধ। বুচনার ফাঁস তার চেয়েও ১০ গুণ ছোট।
তবু বাজারে প্রকাশ্যে এসব জাল বিক্রি হচ্ছে। খালবিলের দেশীয় মাছ কেবল পুষ্টির উৎস নয়, গ্রামীণ জীবনের অংশ। মাছ ধরা, রান্না করা, মেলা বা উৎসবে দেশীয় মাছের উপস্থিতি একসময় ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন সেই স্বাদ ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন জালের ব্যবহার বন্ধ করতে কার্যকর অভিযান, খাল-বিল ও ছোট নদীতে নিয়মিত তদারকি এবং ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের বিকল্প পেশা বা প্রযুক্তি সরবরাহ জরুরি। পোনা সংরক্ষণের জন্য খালভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে এবং স্থানীয় মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুলের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, আমাদের মৎস্য অধিদপ্তরের সুরক্ষা আইন ১৫০-এর ধারায় এই জাল নিষিদ্ধ।
এটি জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ইতিপূর্বে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৪৮০টি জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করেছি। চায়না দুয়ারি, বুচনা ও আটন জালের প্রতিটি ফাঁসের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে একটি প্রজাতি, একটি গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের আশ্বাস। খালবিলের দেশীয় মাছ বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন পদক্ষেপ। না হলে অচিরেই এসব মাছের নাম কেবল বইয়ের পাতায় থাকবে।