পিরোজপুর জেলা হাসপাতাল এখন যেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার এক ভয়াবহ আখড়া। সরকারি হাসপাতাল হয়েও এখানে রোগী সেবার চেয়ে দায়িত্বে গাফিলতি, কর্তব্যে অবহেলা এবং স্বেচ্ছাচারিতাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালের কাগজপত্রে নানা গুরুত্বপূর্ণ রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালুর তথ্য থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশই অচল।
হাসপাতালের প্যাথোলজিতে গিয়ে জানা গেছে, CBC, NS1, Electrolyte, Hb1c, THS-এর মতো জরুরি টেস্ট দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এই বিষয়ে জানতে চাইলে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নিজাম বলেন, “বর্তমানে আমাদের কাছে টেস্টের রিএজেন্ট নেই বিধায় পরীক্ষা চালানো সম্ভব হচ্ছে না।” তবে প্রশ্ন উঠেছে—বছরের পর বছর একই পদে থেকে সরঞ্জাম ঘাটতি বা সেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি তিনি কেন নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করেননি?
ইতিপূর্বে দন্ত বিভাগে নোংরা পরিবেশ ও রক্তমাখা যন্ত্রপাতি দিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগে হাতে-নাতে ধরা পড়েছিলেন। তখন সাংবাদিকদের সামনে দায় স্বীকার করে অনিয়ম বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী সময়েও একই দৃশ্য দেখা গেছে—রক্তমাখা যন্ত্র, অপরিষ্কার চেয়ার ও দুর্গন্ধে ভরা চিকিৎসা কক্ষ। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে ডা. নিজাম কেবল নামমাত্র বকাঝকা করেন দন্ত টেকনোলজিস্টকে। অথচ হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে প্রতিদিন তদারকি করা তারই দায়িত্ব।
দু`দিন পূর্বে হাসপাতাল দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিল, তবুও জেনারেটর চালু করা হয়নি। ইমার্জেন্সি বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের চিকিৎসা চলছিল অন্ধকারে! সাংবাদিকরা বিষয়টি জানালে তখনই আরএমও জেনারেটর অপারেটরকে ফোন করে জেনারেটর চালু করেন। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ—“ডাক্তার নিজামের অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও কর্তৃত্ববাদী আচরণে রোগীরা প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।” সূত্র জানায়, হাসপাতালের ওষুধ কেলেঙ্কারি, রোগীর খাদ্য সরবরাহে অনিয়মসহ একাধিক অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডা. নিজামসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। তবুও তিনি বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন, যা প্রশাসনিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ডা. নিজাম।
বর্তমানে রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে নতুন ধারার অনুসারী হয়ে আবারও প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তার বদলির আদেশ জারি হলেও রহস্যজনকভাবে তা বাতিল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ডা. নিজামের স্ত্রী ডা. মৌসুমি একই হাসপাতালে কর্মরত, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্থানীয় সচেতন মহলের মন্তব্য—“দীর্ঘদিন একই স্থানে থেকে ডা. নিজাম হাসপাতালটিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে বসেছেন। তার অবহেলা, পক্ষপাত ও দুর্নীতির কারণে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা আজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।”
তারা দাবি করেছেন—ডা. নিজামের বিরুদ্ধে অবিলম্বে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করে তাকে আরএমও পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। এছাড়া সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৮টায় চিকিৎসকদের হাসপাতালে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ চিকিৎসক যথাসময়ে কর্মস্থলে না এসে বাইরে নিজেদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। ফলে হাসপাতালের সেবায় সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও রোগীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মতিউর রহমান বলেন, আমি নিয়মিত পিরোজপুর জেলা হাসপাতালের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ দায়িত্বে সচেতন হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। তারপরও যদি কেউ অনিয়ম বা অবহেলা করেন, অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পিরোজপুর জেলা হাসপাতাল এখন যেন সরকারি নয়, বরং ব্যক্তিগত প্রভাব, অনিয়ম আর দুর্নীতির দুর্গে পরিণত হয়েছে—যেখানে সাধারণ রোগীর কণ্ঠস্বর থেমে গেছে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপে।