More

    রোম যখন পুড়ছিলো, নিরো কি সত্যি বাঁশি বাজাচ্ছিলো?

    অবশ্যই পরুন

    ইতিহাসের অংশ “দ্যা গ্রেট ফায়ার অফ রোম” সম্পর্কিত যে কথাটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটি হল “রোম যখন পুড়ছিলো, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো”! এই প্রবাদ যখন আমরা শুনি আমাদের ধারনা হয় যে, দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে রাজা নিরো মনের সুখে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে যেমন একজন দেশপ্রেমিক রাজা নিরো কে ভিলেন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ঠিক তেমনি বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে কালো থাবা পরেছিলো তার পুরো প্রভাবটা অনেকটা অকারণেই সাধারন ব্যাংকারদের উপর পরতেছে।

    যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি রোম হয় তবে সাধারন ব্যাংকাররা যেনো নিরো! নিরো তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন আগুন নেভানোর তবে আগুনের প্রখরতা এতোটাই ছিলো যে তা নিয়ন্ত্রনযোগ্য ছিলোনা আর একারনে রাজপ্রাসাদে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন নিরো অবচেতন মনে একটি বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। আর এভাবেই ইতিহাস তাকে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিনত করেছে। ২০২৪ এর অভ্যত্থানে বিগত সরকারের পতনের পূর্বে যেনো একই অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে সাধারন ব্যাংকাররা!

    পতিত সরকারের আমলে বড় ধাক্কা খায় দেশের ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। নামে বেনামে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় যা দেশের ইতিহাসে আর্থিকখাতে সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়টা আসলে কার? শুধু কি ব্যাংকগুলো দায়ী? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কি কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারে?

    অবশ্যই না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে রাজনৈতিক কারনে ভঙ্গুর অবস্থানে পতিত হয়েছে সে বিষয় বুঝতে অন্তত অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই! অথচ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেবার পর চৌদ্দ মাস পার হলেও এসব বিষয়ে জোরালো বা চাক্ষুষ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে নি। যেটি খুবই হতাশাজনক। পরবর্তীতে যখন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে সেক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে সে বিষয়ে কি আদৌ ভাবছে সংশ্লিষ্টরা!

    নাকি শুধু সাধারন ব্যাংকারদের সুশাসনের গল্প শুনিয়ে আবারো শুভংকরের ফাঁকির পুনরাবৃত্তি ঘটবে আর ভুক্তভোগী হবে এসব সাধারন ব্যাংকাররা! সুতরাং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সকল নীতিমালা পর্যালোচনা ও এসব নীতিমালায় কি কি বাস্তবিক সমস্যা রয়েছে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেনো রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই মোক্ষম সময়। ২৪ এর অভ্যূত্থানের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করা! অথচ রাজনৈতিক কারনে ভুঁগতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মীরা উল্টো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

    প্রতি বছর শুরুতে ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক প্রমোশন প্রক্রিয়া শুরু হয়, তবে দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ২০২৫ সালে এসে দৃশ্যপট যেনো উল্টো! বছর শেষ হতে চললেও এবছরের প্রমোশন প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি, কবে হবে তাও যেনো অনিশ্চিত। অথচ ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পর এসব ব্যাংকগুলোর কর্মীরা নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে জনতা ব্যাংক।

    রাজনৈতিক কারনে পিছিয়ে পরা জনতা ব্যাংক নতুন এমডি এর নেতৃত্বে বিভিন্ন কর্মসূচির সফল করার মাধ্যমে ডিপোজিট সংগ্রহে নতুন মাইলফলক অর্জন করে। এছাড়াও বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণেও চমক দেখায় ব্যাংকটি। জনতা ব্যাংকের মোট ৯২৯ টি শাখার মধ্যে ৯২৫ টি শাখা মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের থেকে সংখায় বেশি। তবে পতিত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নামে বেনামে দেয়া যে ঋণ গুলো খেলাপী হয় তার দায় নিয়ে বড় অঙ্কের লোকসান করে বাকি ৪ টি শাখা। প্রশ্ন হল, এখানে কি সাধারন ব্যাংকারদের কোনো দায় ছিলো? পাশাপাশি এই দায় কি কোনোভাবে বিগত সরকার কিংবা অর্থ মন্ত্রনালয়ের আর্থিক বিভাগ এড়াতে পারে?

    মাত্র কয়েকটি গ্রুপের কাছে রাজনৈতিক প্রভাবে আটকে যাওয়া ঋণগুলো ব্যাংকটির মোট খেলাপী ঋণের প্রায় ৭০%! গত বছর ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকার অবিশ্বাস্য পরিচালন মুনাফা অর্জন করে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। অথচ ইনসেন্টিভ বোনাস নেবার ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নতুন নির্দেশনা জারি করে। ইনসেন্টিভস এর ক্ষেত্রে সুন্দর কাঠামো থাকা ইতিবাচক তবে সর্বোচ্চ ৩ টি ইনসেন্টিভ নির্ধারণ করে দেয়া একেবারেই অযৌক্তিক। কারন ব্যাংক গুলো ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করে এবং সেই মুনাফা থেকে সরকারকে লভ্যাংশ প্রদান করে পাশাপাশি কর্মীদের আরো উৎসাহ দেবার জন্য লাভের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রভিশন রাখে।

    এভাবে যদি সর্বোচ্চ ৩ টি উৎসাহ বোনাস নির্ধারন করে দেয়া হয় সেক্ষেত্রে কর্মীরা যে হতাশ হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাদের মাধ্যমে ঘুরে দাড়াবে সেই মাঠ পর্যায়ের সাধারন কর্মীদের প্রমোশন আটকিয়ে রাখা কিংবা উৎসাহ বোনাস কে হ্রাস করলেই যদি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত হত, তবে এতো বড় বড় কেলেঙ্কারি তো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে হওয়ার কথা ছিলোনা! রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন ১ম শ্রেনীর কর্মকর্তা চাকরির শুরুতে ২২০০০/- টাকা স্কেলে সর্বমোট ৩৪-৩৫ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। বিপরীতে একজন প্রাইভেট ব্যাংকের এমটিও তে জয়েন করলে ব্যাংকভেদে ৬০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন।

    এছাড়াও সরকারি অন্যান্য যেকোনো চাকুরিতে ৯ম কিংবা ১০ম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা যেরকম কর্ম পরিবেশ পেয়ে থাকেন ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা কি সেরকম পরিবেশ পান? বিশেষ করে অল্প পরিসরে তুলনামূলক কম সুবিধা নিয়ে অধিকতর সেবা দিতে হয় এসব কর্মকর্তাদের৷ পুলিশ কিংবা অন্যান্য রাজস্বখাতের চাকুরীতে ঝুঁকি ভাতা দেয়া হলেও ব্যাংকের প্রতিটি কাজে আর্থিক ঝুঁকি থাকার পরও কি তাদের ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয়? অথচ নিজেদের লভাংশ থেকে বেতনভাতা ও লাঞ্চভাতা নিলেও যেনো মাঝে মধ্যেই এ নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনা কম হয়না! রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা সেবা দিয়ে মুনাফা অর্জন করে সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের উদ্দীপনার জন্য লভ্যাংশ শেয়ার একটি চিরাচরিত রীতি।

    এছাড়াও রাজস্বখাতের বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের উৎসাহ বোনাস প্রদান করে থাকে। পেট্রোবাংলার অধীনস্থ সরকারি কোম্পানিগুলো লভাংশ থেকে তাদের কর্মীদের বেশ ভালো পরিমান উৎসাহ ভাতা দেয়, এছাড়াও তেল, গ্যাস, কয়লা, বিদ্যূৎ ইত্যাদী উৎপাদন ও সরবরাহকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের অর্জিত মুনাফা থেকে লভ্যাংশ দিলেও অনেক বছর যাবত কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কর্মীদের উৎসাহ বোনাস দিতে গেলেই বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়!

    এ যেনো চীনের সেই “একদেশ, দুই নীতি” র মতই অবস্থা! অন্যান্য এসব প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের কর্মীদের যে পরিমান বিভিন্ন ভাতা দিচ্ছে সেটা ব্যাংক কর্মীদের অনেক সময় মূল বেতনের সমান! ব্যাংকারদের যে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া হয় সেটি হল হাউজ বিল্ডিং লোন, অথচ এই লোন কেবল ব্যাংকারদের সুবিধা হচ্ছে তাই নয় এটা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের লাভ করারও একটি পন্থা।

    যেহেতু কর্মীদের বেতন থেকে কিস্তি নেয়া হয় পাশাপাশি জিপিএফ লিয়েন রাখা হয় এবং জমি মর্গেজ দিয়ে এই লোন দেয়া হয় তাই এই লোনটি ব্যাংকের তুলনামূলক নিরাপদ লোন যা খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাংকারদের ব্যাপক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, হামলা কিংবা লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। সম্প্রতি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একটি শাখার খেলাপি ঋণ আদায়ের পদক্ষেপ নিতে গেলে ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা যার প্রকৃষ্ট উদাহরন!

    দেশের কোনো অঞ্চলে একজন শ্রমজীবী লাঞ্ছিত হলেও সাড়া দেশে তাদের সংগঠনগুলো কর্মবিরতি পালন করেন কিন্তু দেশের অর্থনীতির চালা সচল রাখতে ব্যাংকাররা লাঞ্চিত হওয়ার পরও কর্মবিরতি পালন করার এমন নজির নেই। এছাড়াও করোনা মহামারীর সময়ে যেখানে দেশের সব সরকারি বেসরকারি অফিস বন্ধ ছিলো, পুলিশ ও ডাক্তারদের পাশাপাশি ব্যাংকার রা কিন্তু তখন সম্মুখ সারিতে ছিলো। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আজকের পরিস্থিতি যাতে ভবিষ্যতে তৈরী না হয় সে ব্যপারে কিছু পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী ছিলো।

    আর বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী ছাটাই কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রমোশন, উৎসাহ বোনাস হ্রাস করে সাধারন ব্যাংকারদের উৎসাহ উদ্দীপনা বাধাগ্রস্থ হলে সেটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কতটুকু ভালো হবে সেটিও চিন্তার বিষয়! সর্বোপরি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দূরাবস্থার জন্য সাধারন কর্মীদের সামাজিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়!

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    ঝটিকা মিছিল থেকে আ’লীগের ৩০০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার

    চলতি বছর রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় তিন হাজার আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন...