মোঃ রোকনুজ্জামান শরীফ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ আমাদের জীবনের অক্সিজেন হয়ে উঠেছে। খবর, জ্ঞান, বিনোদন, মত প্রকাশ—সবকিছুর প্রধান উৎস এখন এই ভার্চুয়াল জগৎ। এক ক্লিকে বিশ্ব হাতের মুঠোয়। নিঃসন্দেহে এটি আধুনিক সভ্যতার এক বড় অর্জন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই অর্জন আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি? সভ্যতার হাতিয়ার হিসেবে, নাকি অশালীনতার উন্মুক্ত লাইসেন্স হিসেবে? ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ঢুকলেই চোখে পড়ে ভাষার ভয়াবহ অবক্ষয়। কুরুচিপূর্ণ শব্দ, ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ, অশ্রাব্য গালাগাল—সবকিছু যেন ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ছদ্মবেশে বৈধতা পেয়েছে। যেন এখানে শালীনতা মানেই দুর্বলতা, আর সংযম মানেই পিছিয়ে থাকা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই মাধ্যমের দর্শক শুধু প্রাপ্তবয়স্করা নন। শিশু, কিশোর, তরুণ—সব বয়সের মানুষ একই পর্দায় একই কন্টেন্ট দেখছে। বাবা-মায়ের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সন্তানটি যখন একই স্ট্যাটাস পড়ে, তখন সেই ভাষা শুধু একটি লেখা থাকে না; সেটি হয়ে ওঠে শেখার উপকরণ। প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কী শেখাচ্ছি? আজকাল অনেকেই বলেন, “যা ইচ্ছে বলব, এটা আমার টাইমলাইন।” কিন্তু বাস্তবতা হলো—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়। এটি একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, যেখানে আপনার প্রতিটি শব্দের সামাজিক দায় রয়েছে।
আপনার স্ট্যাটাস পড়ছে আপনার সন্তান, আপনার সহকর্মী, আপনার শিক্ষার্থী, এমনকি আপনার মূল্যবোধ থেকে শেখা মানুষও। সেখানে ভাষার দায়িত্বহীনতা মানে সমাজের ওপর দায়িত্বহীন আচরণ। আরও ভয়ংকর হলো, অশালীন ভাষা এখন স্বাভাবিকীকরণ হয়ে যাচ্ছে। যেটা একসময় লজ্জার ছিল, আজ সেটাই ‘ট্রেন্ডিং কনটেন্ট’। লাইক, শেয়ার আর রিচ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় অনেকে ভাষার শেষ সীমাটুকুও মানছেন না। ফলাফল—একটি মানসিকভাবে দূষিত ভার্চুয়াল পরিবেশ, যেখানে সুস্থ চিন্তার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত। শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও মারাত্মক। অপ্রাপ্ত বয়সে তারা যা দেখে, তা-ই তাদের কৌতূহল জাগায়, আচরণ গড়ে তোলে। কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস, বিকৃত রসিকতা কিংবা অশ্লীল ইঙ্গিত তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক ছাপ ফেলে। অনেক সময় তারা না বুঝেই ভুল পথে পা বাড়ায়—যার দায় শেষ পর্যন্ত পুরো সমাজকেই বহন করতে হয়।
এখানে প্রশ্ন আসে—রাষ্ট্র, প্ল্যাটফর্ম বা আইন কি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? বাস্তবতা হলো, কোনো আইন বা অ্যালগরিদম একা যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রণ হলো ব্যক্তিগত বিবেক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ। আমরা কী লিখছি, কেন লিখছি, কার জন্য লিখছি—এই প্রশ্নগুলো লেখার আগে একবার ভাবা জরুরি। সাবলীল ভাষা মানে ভণ্ডামি নয়। সাবলীলতা মানে দুর্বলতা নয়। বরং এটি মানসিক পরিপক্বতার পরিচয়। তীব্র সমালোচনা করা যায়, প্রতিবাদ করা যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়—কিন্তু শালীন ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায়। ভাষা যত সংযত হবে, বক্তব্য তত শক্তিশালী হবে—এটাই বাস্তব সত্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোক জ্ঞানচর্চার জায়গা, সুস্থ বিতর্কের ক্ষেত্র, সৃজনশীলতার প্ল্যাটফর্ম। এটিকে যদি আমরা অশালীনতার ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত করি, তবে ক্ষতি শুধু ব্যক্তির নয়—পুরো সমাজের। আজ সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে—আমরা কি একটি দায়িত্বশীল ডিজিটাল সমাজ গড়তে চাই, নাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চাই ভাষাহীন, মূল্যবোধহীন এক ভার্চুয়াল জঙ্গল?
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত থাকবে শালীনতা, সংযম ও সামাজিক দায়। না হলে স্বাধীনতা পরিণত হবে স্বেচ্ছাচারিতায়—আর তার মূল্য দিতে হবে আমাদেরই। ভাষা শুধু কথা নয়, ভাষাই সংস্কৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষাই বলে দেয়—আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আর কোন পথে হাঁটছি।
