পটুয়াখালী জেলায় ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়মের চিত্র দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আইন ও পরিবেশগত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে জেলার অধিকাংশ ইটভাটায় নির্বিচারে কাঠ ও লাকড়ি পুড়িয়ে ইট উৎপাদন করা হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে এসব কাঠ সংগ্রহ করায় বনসম্পদ ও পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ইটভাটার নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র, আর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনের তুলনায় প্রশাসনের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ ইটভাটা নির্ধারিত নিয়মকানুন না মেনেই দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কৃষিজমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসত এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলায় বর্তমানে মোট ৭৮টি ইটভাটা রয়েছে।
এর মধ্যে বৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৫৭টি। সদর উপজেলায় ১৫টি, মির্জাগঞ্জে ২টি, বাউফলে ৫টি, কলাপাড়ায় ৩০টি, গলাচিপায় ৩টি এবং দুমকীতে ২টি বৈধ ইটভাটা রয়েছে। অপরদিকে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ২১টি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৪টি, কলাপাড়ায় ৩টি, বাউফলে ৩টি এবং দুমকীতে ১টি ইটভাটা রয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আরও অন্তত ১০টি অবৈধ ইটভাটা কার্যক্রম চালাচ্ছে, যেগুলোর কোন ধরনেরপরিবেশগত ছাড়পত্র নেই।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অধিকাংশ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়েক হাজার মন কাঠ ভাটার আঙিনায় স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কাঠ ফাঁড়ানোর জন্য প্রায় প্রতিটি ইটভাটার সঙ্গে রয়েছে অবৈধ করাতকল। এসব করাতকলের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে ছোট টুকরো করে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, এসব করাতকলের কোনো বৈধ অনুমোদন নেই। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জেলার ইটভাটাগুলোর মধ্যে প্রায় ২০টিতে কয়লা ব্যবহার করা হলেও বাকিগুলোতে প্রধান জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে।
হিসাব অনুযায়ী, এক লক্ষ ইট উৎপাদনে প্রায় ৬৫ টন কাঠের প্রয়োজন হয়। একটি ইটভাটায় এক মৌসুমে গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসাবে জেলায় অন্তত ৬০টি ইটভাটায় কাঠ ব্যবহার করা হলে এক মৌসুমেই প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন কাঠ পুড়ছে। এতে বনসম্পদ ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পটুয়াখালী পৌর শহরের অদূরে লাউকাঠি ইউনিয়নের ঢেউখালি গ্রামে নদীর তীর ঘেঁষে একই সারিতে অন্তত আটটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এসব ভাটার একটি অংশ নদীতীরবর্তী সরকারি জমি দখল করে স্থাপন করা হয়েছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ এলাকা ও ভেরিবাঁধের নিকটে ইটভাটা স্থাপনের ফলে নদীভাঙন ও বাঁধ ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েছে। ইট ও কাঠ পরিবহনে ব্যবহৃত ভারী ট্রলি ও ট্রাক চলাচলের কারণে লাউকাঠি ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভেরিবাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে বাঁধ ভেঙে পড়ায় জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মেঠোপথ ও পাকা সড়ক ভেঙে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
ভাটার ধুলো, ছাই ও ধোঁয়ায় আশপাশের বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছে। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘরে ঘরে ধুলো জমে যাচ্ছে, শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট বেড়েছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কয়েকটি ইটভাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কমে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবু স্টার ব্রিকস ও বাবু ব্রিকস নামে পাশাপাশি দুটি ইটভাটা প্রায় ১৫ থেকে ১৮ একর জমির ওপর স্থাপিত, যা ২০১৯ সাল থেকে ভাড়াটিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। একই ভাড়াটিয়া পার্শ্ববর্তী রুপালি ব্রিকস নামের আরেকটি ইটভাটাও পরিচালনা করছে, যা ২০২৫ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ইটভাটার প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া বুশরা ব্রিকস নামে পাশাপাশি দুটি অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রমের তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ভাটায় পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী ও শিশু শ্রমিকদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। ইট পোড়ানোর জন্য ভাটার আশপাশে কাঠের বিশাল স্তুপ করে রাখা হয়েছে।
অনুমোদনবিহীনভাবে কাঠ পোড়ানো বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ধারা ২১ এবং বাংলাদেশ বন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৬৫ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ১ থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
এছাড়া নদীতীর ও সরকারি জমিতে ইটভাটা স্থাপন ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ধারা ৩-এর পরিপন্থী। বাবু স্টার ব্রিকসের ম্যানেজার বাদল বলেন, ইটের বাজারে কম দামের ইটের চাহিদা বেশি। কয়লা দিয়ে পোড়ালে খরচ বেড়ে যায়। তাই আমরা কাঠ ব্যবহার করি। পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এলে আগেই কাঠ সরিয়ে রাখা হয়। মোবাইল কোর্ট হলে জরিমানা দিতে হয়। লাউকাঠি ইউনিয়নের বাসিন্দা সেলিম জোমাদ্দার বলেন, তিন ফসলি জমির মাটি কেটে পুকুর বানিয়ে সেই মাটি ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
এতে আমাদের জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধান, নারিকেল, সুপারি, আম ও কাঁঠালের ফলন কমে গেছে। রাস্তা ও ভেরিবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। পটুয়াখালী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক লোভানা জামিল বলেন, কোনো ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে এবং কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহারের প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ডা. মোহাম্মদ শহীদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ইটভাটায় কোনো অনিয়ম বা কাঠ ব্যবহারের খবর পাওয়া মাত্রই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
