বয়স ৮৫ থেকে নব্বই হবে। নিজে দরিদ্র হয়েও এক সময় অসহায় মানুষদের সাহায্য করতেন। বিনা টাকায় করতেন জন্ডিসের চিকিৎসা। তবে এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। হাঁটতেও কষ্ট হয়। ভুগছেন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে।
বলছিলাম বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের কোদালধোয়া গ্রামের ভূমিহীন বৃদ্ধা আমদি বালার কথা। আপনজন বলতে কেউ নেই। থাকতেন অন্যের একটি ছাপরাঘরে। ঘরটিতে বিছানা বলতে ছিল ভাঙা চৌকিতে পাতানো একটি কাঁথা। দরজা-জানালাও ভেঙে গেছে। ছিল ঝড়-তুফানের ভয়। বর্ষার সময় পানি আর শীতে বাতাসের কষ্ট। সামান্য বৃষ্টি হলেই ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরে পানি পড়তো। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে সারা রাত জেগে থাকতে হতো বৃদ্ধা আমদি বালাকে।
আজ ৮ মার্চ (সোমবার) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। তাই এই দিনেই মানবেতর জীবন যাপন করা বৃদ্ধা আমদি বালাকে টিনশেডের একটি ঘর দিয়েছে মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশন।
সোমবার বিকেলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঘরটি হস্তান্তর করেছেন ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। ঘর পেয়ে দারুণ খুশি বৃদ্ধা আমদি বালা। সংগঠনটির এমন কাজের প্রশংসা করছেন স্থানীয়রাও।
কোদালধোয়া গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ একাধিক বাসিন্দা জানান, আমদি বালার আদি বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়নের রামশীল গ্রামে। ভব সুন্দর বাড়ৈ ও লক্ষি বাড়ৈ দম্পতির বড় মেয়ে আমদি বালা। ছোট বেলাতেই আমদি বালার দুই ভাই মারা যান। তাই বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে ছিলেন তিনি। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল আমদি বালার। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হতো না তাকে।
সাত বছর বয়সেই আমদি বালাকে পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাটরা গ্রামের দশরত হালদারের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। বিয়ের কিছু দিন না যেতেই আমদি বালার ওপর যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন শুরু হয়। স্বামী দশরত হালদার তাকে পৈতৃক সম্পত্তি লিখে দিতে বলেছিলেন। তাতে রাজি হননি আমদি বালা। জমির জন্য দিনের পর দিন অমানবিক নির্যাতন করতেন স্বামী। বাবা-মাকে বলেও লাভ হয়নি। তারা আমদি বালাকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। তারা অল্প বয়সে আমদি বালার বিয়ে বিচ্ছেদ হোক চাচ্ছিলেন না। সামাজিক মানসম্মানের বিষয়টিও তাদের চিন্তার মধ্যে ছিল।
তবে স্বামীর সংসারে নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলছিল। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক বছরের মাথায় স্বামীর ঘর ছাড়েন আট বছরের আমদি বালা। পালিয়ে কোদালধোয়া গ্রামে চলে আসেন। সেখানে দেখা হয় সতীশ বালা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। আমদি বালার দুঃখের কথা শুনে ঠাঁই দেন তার বাড়িতে।
সেখানে আমদি বালার পরিচয় হয় সতীশ বালার ছোট ভাই মতীলাল বালার সঙ্গে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এলাকার অনেক মানুষ তাদের এই সম্পর্ক একদম ভাল চোখে দেখেননি।
তারা আড়ালে-আবডালে সমালোচনা করেছেন। কারণ গ্রামের মানুষের কাছে সতীশ বালা ও ছোটভাই মতীলাল বালা ছিল সম্মানিত ব্যক্তি। তাই স্বামীর সংসার থেকে পালিয়ে আসা আমদি বালার সঙ্গে মতীলাল বালার সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি তারা। এরপর কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে। এখনো তাদের ওই সম্পর্ক ঘিরে নানা কথা প্রচলিত আছে গ্রামে।
তারা আরও বলেন, শুনেছি কয়েক বছর পর মতীলাল বালা আমদি বালাকে বিয়ে করেছিলেন। এরপর তারা সুখেই ছিলেন। কিন্তু ২২ বছর আগে মতীলাল বালা মারা গেলে আমদি বালার জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো আর্থিক সঞ্চয় ছিল না।
মতিলাল বালা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অভাব-অনাটনের কারণে মাথা গোঁজার ভিটেটিও বিক্রি করেছিলেন। সহায়-সম্বল বলতে কিছুই ছিল না নিঃসন্তান আমদি বালার। বাবা ও মা মারা যাওয়ায় সেখান থেকেও সাহায্যের কোনো সুযোগ ছিল না। এই অবস্থায় শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। ধার-দেনা করে কয়েকটি গাভী কিনে লালন-পালন করা শুরু করেন। শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। দুধ বিক্রি করে মাসে যা আয় হতো তার বেশিরভাগ টাকা দিয়ে দিতেন পাওনাদারদের। কিছু টাকা রাখতেন খাবারের জন্য। এভাবেই তার দিন কাটছিল। কয়েক বছর ধরে আমদি বালার শরীর আর পারছে না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আমদি বালার হাঁটতে কষ্ট হয়। বার্ধক্য জনিত নানা রোগে ভুগছেন তিনি।
আমদি বালার প্রতিবেশী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা সুরেশ চন্দ্র বৈদ্য (৬৪) বলেন, আমদি বালা একজন সংগ্রামী নারী। পরোপকারী হিসেবেও গ্রামে তার পরিচয় রয়েছে। আমদি বালা ধাত্রী বিদ্যায় পারদর্শী। গ্রামের অনেক নারীদের তিনি সেবা দিয়েছেন। তার সহায়তায় নিরাপদে অনেক প্রসূতির সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আপদ-বিপদ, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তিনি ছুটে যেতেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য যেন এক আশীর্বাদ। এছাড়া গাভী পালনের সময় গরিবদের তিনি বিনা টাকায় দুধ দিয়ে দিতেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া শুনেছি তিনি জন্ডিসের রোগীদের সারিয়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু সেবার বিনিময় আমদি বালা টাকা নিয়েছেন বলে শুনিনি।’
সুরেশ চন্দ্র বৈদ্য বলেন, ‘সংগ্রামী জীবন ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত এমন একজন নিঃসঙ্গ নারীকে মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নতুন ঘর দেয়া হয়েছে। এটা মানবতার একটি বড় নিদর্শন।’
কোদলধোয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বড়বাশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নবনী বৈদ্য জানান, করোনাকালে মরদেহ সৎকার, দুস্থদের খাবার বিতরণ, শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ, গাছের চারা রোপণসহ সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আগৈলঝাড়াবাসীর নজর কেড়েছে মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশন। তারা এবার অসহায় বিধবা আমদি বালার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার জন্য ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। তাদের সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।’
মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মলয় ঘটক জানান, ৯০ বছর বয়সী আমদি বালার স্বামী, সন্তান কেউ নেই। অন্যের জমিতে জরাজীর্ণ একটি ছাপরাঘরে তিনি থাকছেন। আমদি বালা সমাজের জ্যেষ্ঠ নাগরিক। জীবনের সেরা সময়টাকে তিনি একসময় বিলিয়ে দিয়েছেন পরিবারকে, সমাজকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, হারিয়েছেন পরিবার ও সমাজের মনোযোগ। সেই আবেগ ও অনুভূতি থেকে মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সদস্যরা মিলে আমদি বালার জন্য একটি দোচালা টিনের ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। এ কাজে সহায়তা করেছে বিবেকানন্দ স্টাডি এন্ড ফিল্যান্থ্রপিক সেন্টার।
তিনি আরও জানান, গত কয়েকমাস ধরে বৃদ্ধা আমদি বালাকে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে মনোরঞ্জন ঘটক চ্যারিটি ফাউন্ডেশন। আগামীতেও এই বৃদ্ধার পাশে থাকবে ফাউন্ডেশনটি।