বলা হয়েছিল, কয়েক মাস পর শিশুটিকে তুলে নেওয়া হবে। আপনি আপনার স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে সুখী হবে; কিন্তু আনোয়ার হোসেনের ভাগ্যের পাণ্ডুলিপিতে অন্য কিছু লেখা ছিল। শিশুটিকে কোলে না নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন তিনি। গত রোববার রাতে রাজধানীর গুলশানে একটি আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রাণ বাঁচাতে তিনি সপ্তম তলা থেকে লাফ দেন। সে রাতেই তার মৃত্যু হয়।
আনোয়ারের বাড়ি ভোলার দৌলতখানে। ওই ভবনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের (বিসিবি) পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসায় রান্নার কাজ করতেন তিনি। গ্রামেই থাকেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আমেনা বেগম। স্বজনরা জানান, স্বামীকে হারিয়ে পাগল আমেনা। বারবার বিলাপ করছিল, আনোয়ার অনাগত সন্তানের মুখও দেখতে পায়নি।
ফাহিম সিনহার স্ত্রী শামা রহমান সিনহা আগুনের মুখে ওই ভবন থেকে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেন। তার আগেই তিনি পরিবারের সদস্য ও গৃহকর্মীদের আগুন থেকে নিরাপদে নামিয়ে আনেন। সবাই রক্ষা পেলেও শামা রহমান এখন মৃত্যুশয্যায়। তিনি শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নিহত আনোয়ারের ভাই জুলহাস হোসেন কালবেলাকে বলেন, আগুন লাগার পর আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। টেলিভিশনে খবর দেখে বেলা ২টার দিকে হাসপাতালে তার ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন তিনি।
তিনি জানান, ওই ভাই বিবিসি পরিচালক ফাহিম সিনহার বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন। বাড়ি বাজার করতেন। মনে হয় আমেনা বেগম গ্রামেই আছে। সে গর্ভবতী. ভাই সন্তানের মুখও দেখতে পারেননি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন আনোয়ার হোসেন ছাড়াও মো. রাজু নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকালে গুলশানের জেডএইচ শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। রাজুর মরদেহ গাজীপুরের কালীগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়।
তার আত্মীয়দের আগুন থেকে বাঁচানোর পর তার মৃত্যুশয্যায়: ফাহিম সিনহা এবং তার স্ত্রী তাদের আত্মীয়দের সাথে ১২ তলার একটি ডুপ্লেক্সে থাকেন। আগুন লাগার পর বাড়িতেই ছিলেন স্ত্রী শামা রহমান সিনহা। স্বজনরা জানান, ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠলে তিনি বাড়ির কর্মচারীসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সে লিফট দিয়ে একে একে সবাইকে নামিয়ে দিল। এরপর তিনি গৃহকর্মী রীনা আক্তারকে নিয়ে নামার চেষ্টা করেন। তবে লিফট থামলে তিনি বের হতে পারলেও শরীরে আগুন ধরে যায়। তা সত্ত্বেও তিনি নিরাপদে গৃহকর্ত্রীকে পাশ কাটিয়েছেন।
গৃহকর্মী রিনা আক্তার জানান, ঘটনার সময় তারা ১২ তলায় ছিলেন। আগুন লাগার পর তার ম্যাডাম কয়েকজনকে লিফটে নামিয়ে দেন। তারপর তারা দুজনেই তাড়াহুড়ো করে লিফট থেকে নেমে আসার চেষ্টা করল; কিন্তু সপ্তম তলায় যাওয়ার পর লিফট বন্ধ হয়ে যায়। তখন ম্যাডাম লিফটের গ্লাস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন। এরপর তার শরীরে আগুন ধরলে তিনি আবার সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির দিকে যান। পরে তিনি সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, রোববার মধ্যরাতে শামা রহমান সিনহাকে ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি শঙ্কামুক্ত না হওয়ায় তার চিকিৎসার জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
তিনি জানান, আগুনে শামা রহমানের শরীর পুড়ে না গেলেও ধোঁয়ার কারণে তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। লাফ দেওয়ার কারণে মাথার পেছনে আঘাত পান তিনি। তাকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
গুলশানের অগ্নিকাণ্ডে ইনস্টিটিউটে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। এদের মধ্যে মোশা সিকদার (৩৩) ও রওশন আলী (৩৫) নামে দুজনকে চিকিৎসা শেষে গতকাল ছুটি দেওয়া হয়েছে। ওই ভবনের ১০ তলার একটি ফ্ল্যাটের চালক মুছা, রওশন অফিসের কাজে তার বসের বাসায় যান।
রওশন কালবেলাকে বলেন, ভবনের মেঝেতে আগুন লেগেছে, চার ঘণ্টা ধরে ভেতরে আটকে ছিলেন তিনি। তিনি বারবার মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন। এক পর্যায়ে তার চোখের সামনে চারজন লাফিয়ে পড়ে। তারপর তিনিও ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে ভেবেছিল, লাফ দিয়ে মারা গেলেও তার বাবা-মা অন্তত বাড়িতে লাশ দেখতে পাবে। আগুনে পুড়ে মরলে লাশ পাবেন না। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে ফ্ল্যাটের জানালা ভেঙ্গে একে একে তাদের উদ্ধার করে।