প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার কর্মসূচি শুরু করেছে। তাদের রুটি, বিস্কুট, ডিম, কলা ও দুধ দেওয়ার নির্দেশনা আছে। চারটি উপাদানের মধ্যে দুটি প্রতিদিন দিতে হবে। তালিকা অনুযায়ী খাদ্য বিতরণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, কর্মসূচির আওতাভুক্ত বরিশাল বিভাগের ৮ উপজেলায় দুধ ও বিস্কুট এখনও দেওয়া হয়নি। প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক দিন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে খাদ্য সরবরাহ হয় না। সোমবার বনরুটি ও দুধ, ফর্টিফায়েড বিস্কুট ও কলা দেওয়ার নির্দেশনা আছে। এই দুদিন শুধু রুটি ও কলা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অভিযোগ, আগের দিন সেদ্ধ করা ডিম বিতরণ করা হয়। কাঁচা অথবা অতিরিক্ত পেকে যাওয়া কলা দেওয়া হয়, যা খাওয়ার উপযোগী নয়। দুপুর ১টা থেকে ২টায় খাবার পৌঁছানোয় প্রথম শিফটের শিক্ষার্থীরা খাবার পায় না। তাদের দুপুর ১২টায় ছুটি হয়ে যায়। এ নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
বিদ্যালয়ে বিতরণ করা খাদ্য প্রসঙ্গে বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রাফিজা আক্তারের ভাষ্য, ‘কলা পঁচা, ডিম আগের দিন সেদ্ধ করা; খাওয়া যায় না।’ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত ১৭ নভেম্বর থেকে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফিডিং কর্মসূচি’র কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্মসূচির মেয়াদ তিন বছর। কর্মসূচির আওতাভুক্ত হয়েছে সারাদেশে দেড়শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানগুলোতে খাদ্য সরবরাহের জন্য মোট ২০টি প্যাকেজে দরপত্র ডাকা হয়েছিল।
এর মধ্যে ৮টি প্যাকেজের দরপত্র সম্পন্ন হয়েছে। অন্য ১২টি প্যাকেজে পুনঃদরপত্র ডাকা হয়েছে। সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগে ২০টি প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক দুটি প্যাকেজ। বরিশালের বাকেরগঞ্জ, বানারীপাড়া, গৌরনদী, হিজলা, মুলাদী, উজিরপুর এবং ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে করা হয়েছে বরিশাল প্যাকেজ-১। পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলার ১২টি উপজেলা নিয়ে বরিশাল-২ প্যাকেজটি পুনঃদরপত্রে আছে। বরিশাল-১ প্যাকেজে দরপত্রের মাধ্যমে এক বছরের কার্যাদেশ পেয়েছে আইল্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি।
টাকার পরিমাণ ৬৫ কোটি ৬১ লাখ ৩৫ হাজার ৯২১ টাকা। ৮ উপজেলায় মোট ১ হাজার ২৪৮ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টিকর খাদ্য দেবে এ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৫১। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৯০ ভাগ উপস্থিতি হিসেবে খাদ্য সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। জানা গেছে, আইল্যান্ড ট্রেডিং চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়ভাবে একাধিক এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট নিযুক্ত করে উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাদ্য সরবরাহ করছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি উপজেলায় খাদ্য নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বাকেরগঞ্জ, বানারীপাড়া ও হিজলা এবং ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একই অভিযোগ।
বানারীপাড়া উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকরা ক্ষোভে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, নাটুয়ারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মনিরুল আলম। তিনি জানান, সরবরাহ করা রুটি ও কলার মান ঠিক থাকে না। বিষ্ঠাযুক্ত ডিমও দেওয়া হয়েছে। উপজেলার ১২৬টি বিদ্যালয়ের সবটাতে একই অভিযোগ। তিনি জানান, রাত ১০টায় বিদ্যালয়ে খাদ্য পৌঁছানো হয়– এমন নজির আছে। সেই খাদ্য পরদিন বিতরণ করতে হয়। বেলা ২টার পর খাবার পৌঁছানো নিয়মিত ঘটনা।
একই উপজেলার মরিচবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে মঙ্গলবার রুটি ও কলা দিয়েছে। তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়– বুধবার সরবরাহ হবে না। প্রতি প্যাকেটে ৬০ গ্রাম ওজনের দুটি রুটি থাকে। মঙ্গলবার সব শিক্ষার্থীকে একটি রুটি দেন। অবশিষ্ট আরেকটি রুটি ও কলা বুধবার বিতরণ করেছেন। ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার পশ্চিম সিটকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাইন উদ্দিন খলিফা বুধবার বেলা ২টায় জানান, তখন পর্যন্ত তাঁর বিদ্যালয়ে খাদ্য পৌঁছেনি।
মঙ্গলবার নির্ধারিত ছিল কলা। সেদিন কিছুই দেয়নি। মাইন উদ্দিন জানান, তিনি অনেক কড়াকড়ি করেছেন। তারপরও কখনোই দুপুর ১টার আগে খাদ্য পৌঁছে না। সকালের শিফটের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টার মধ্যে ছুটি হয়। তারা বঞ্চিত হয়। বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বিরঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমানের অভিযোগ, তাঁর প্রতিষ্ঠানে একটি উপাদানের খাদ্য দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর ঠিকাদারের লোক খাদ্য নিয়ে পৌঁছে।
এতে খাদ্যের অপচয় হয়। বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, এ উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ৬ পয়েন্ট থেকে খাদ্য সরবরাহ হয়। একবার গাড়ি দুর্ঘটনায় টানা ৩ দিন সরবরাহ বন্ধ ছিল। শিশুদের উপযোগী মানসম্মত খাবার দিতে পারছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বানারীপাড়া উপজেলার বিদ্যালয়গুলোতে খাদ্য সরবরাহ এজেন্ট হলেন কাজী কামাল। তাঁর ভাই কাজী তরিকুল এটি পরিচালনা করেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে তরিকুল বলেন, তাদের সরবরাহ তালিকায় দুধ ও বিস্কুট নেই। তাই এ দুটি দেন না। অনভিজ্ঞতার কারণে শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হয়েছিল। ভুলগুলো সমাধানের চেষ্টা করছেন। ডিম আগের দিন সেদ্ধ করার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইল্যান্ড ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘১৩ নভেম্বর ওয়ার্ক অর্ডার পেয়ে তড়িঘড়ি করে ১৭ নভেম্বর বিতরণ শুরু করেছি। প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয়দের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাদ্য পৌঁছানো হয়। কিছু অনিয়মের খবর আমিও পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বিতরণকারীরা দায়ী। তাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনে অন্যদের দায়িত্ব দেব।’ এ ছাড়া স্থানীয় রাজনীতিরও শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন শাহাদত। তিনি জানান, দুধ ও বিস্কুট সরবরাহের দরপত্র পেয়েছে একটি কোম্পানি। তারা জানুয়ারিতে বিতরণ শুরু করবে।
এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, শিশুর পরিপূর্ণ দেহ গঠনে ছয় প্রকার সুষম খাদ্য প্রয়োজন। ডিম ও দুধে ছয় প্রকার সুষম খাদ্যের উপাদান রয়েছে। বনরুটি ও বিস্কুট গমের আটা-ময়দায় তৈরি। এটি শক্তিদায়ক খাবার। কলায় আছে ভিটামিন ও খনিজ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা প্রতিটি খাদ্যই শিশুদের জন্য অপরিহার্য। তবে এসব খাবার মানসম্মতনা হলে নিয়মিত খেলেও শিশুদের শরীরে নানা ঘাটতি থেকে যাবে।
