নিজস্ব প্রতিবেদক : পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানার কারিশমায় মেডিকেল রিপোর্টে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও হত্যা মামলা দায়ের, সেই অনুযায়ী ভূয়া চার্জশিট প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফ্যাসিস্টের দোসর রিয়াজের সহযোগিতায় বাদীর ঘরে ভূরিভোজের মধ্যদিয়ে সাজানো হত্যা মামলায় আসামীপক্ষকে এলাকা ছাড়া করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সোহেল রানা। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে আসে।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়ার ছোট চৌদ্দকানি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মামলার নথি, আসামীপক্ষের অভিযোগ এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়- ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ঘটনাস্থল উলানিয়ায় নশু ঘড়ামির নিজ বাড়িতে সকালে দু’পক্ষের ঝগড়া-ঝাটি হয়।
ঝগড়ার শেষ পর্যায়ে নিহত আমেনা বেগমের মেয়ে লাকী তার অসুস্থ মাকে বলেন তোমার ছেলের সাথে মারামারি হয় আর তুমি ঘরে বসে আছো- এই বলে টেনে হিছড়ে ঘটনাস্থলে নেন। আমেনা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে গলাচিপা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় আমেনা বেগমের সাথে স্বামী নশু ঘড়ামি হাসপাতালে গেলে বাদী এবং রিয়াজ তাকে হত্যাকারী আখ্যা দিয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করান। এ ঘটনায় গলাচিপা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ছেলে শাহিন ঘড়ামি (৩২)। এরপরই শুরু হয় মামলা, হামলা, ঘর-বাড়ি, গাছ পালা, পুকুরের মাছ লুটপাটের ঘটনা।
দুইদিন পর ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় মামলার ২নং আসামি মোঃ আমিনুর মুন্সিকে। মামলায় আসামী করা হয়- মোঃ নশু ঘড়ামি (৬০), মোঃ আমিনুর মুন্সি (৫০), মোঃ রিপন ঘড়ামি (৩২), মোঃ জাহাঙ্গীর ঘড়ামি (৫৫), মোঃ শানু ঘড়ামি (৬৫), মোঃ আনোয়ার মুন্সি (৬০), মোঃ মাসুম ঘড়ামি (২৫), মোসাঃ নাজমা বেগম (৪৫)সহ অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জন।
উল্লেখ্য, ওই মারামারির ঘটনায় দু’পক্ষের অন্য কাউকে ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে হয়নি। আর খবরের মধ্যে খবর হলো ষাটোর্ধ্ব আমেনা বেগম বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘ ৬ মাস পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। ঘটনার কিছুদিন পূর্বে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেন বলে স্বামী নশু ঘড়ামি জানিয়েছেন। এদিকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ আমেনা বেগমের লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেয় পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যার স্মারক নং- (পমেকহা/পটুয়া/২০২৫/৭১)।
সেই প্রতিবেদনে লাশের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ নাই। তারপরও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা বিভিন্ন তালবাহানা শেষে মামলার চার্জশিট থেকে ৩ জন আসামিকে বাদ দিয়ে আরও একজনকে অন্তর্ভূক্ত করে চার্জসিট প্রদান করেন। তিনি চার্জশিটে উল্লেখ করেন- ঘটনার দিন আসামীরা বাদীপক্ষের লোকজনকে দড়ি দিয়া গাছের সাথে বেধে এলোপাথারী মারধর করে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে।
মামলার ১নং আসামী মোঃ নশু ঘড়ামি তার স্ত্রী আমিনা বেগমকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে বুকে ঘুষি মারলে তিনি মাটিতে পড়ে যায়। তখন ২ নং আসামি মোঃ আমিনুর মুন্সি আমিনা বেগমের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তার তলপেটে স্বজোড়ে লাথি মারলে আমিনা বেগম বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে।
যার কোন সত্যতা মেডিকেল রিপোর্টে পাওয়া যায়নি। মামলার ২নং আসামি মোঃ আমিনুর মুন্সি অভিযোগ করে বলেন- মামলার তদন্তকালীন সময় এসআই সোহেল রানা মামলা থেকে আসামীদের অব্যহতি দেওয়ার কথা বলে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। মামলার ঝামেলা এড়াতে আমরা এসআই সোহেল রানাকে ৪ লাখ টাকা দেই। যে টাকা থানার সামনে বসে মুসার মাধ্যমে দেওয়া হয়। ৪ লাখ টাকা নিলেও খুশি হতে পারেননি এসআই সোহেল রানা। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে ভূয়া চার্জশিট প্রদান করেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি উঠে আসলেও বিনা অপরাধে আমি ও আমার মামা ১০ মাস ১৭ দিন কারাবাস করেছি।
আবার ৪ লাখ টাকাও পুলিশকে দিয়েছি। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ঢাকার ওয়ারি থানায় কর্মরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনের মহানায়ক ছিলেন সোহেল রানা। ৫ আগস্টের পর তিনি বদলী হয়ে গলাচিপা থানায় যোগদান করেই আমেনা বেগম নিহতের ঘটনায় মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। চার্জশিট প্রদানের পূর্বে গত ২৫ মে বাদীর বাড়িতে ভূরিভোজে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যা রীতিমত এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। জানা যায়, অল্প সময়ের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা এবং বাদীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এদিকে বাদীর পক্ষ হয়ে আসামিদের ভিটেবাড়ি ছাড়া করতে মরিয়া হয়ে উঠেন একই বাড়ির বাসিন্দা রিয়াজ। কে এই রিয়াজ? সরেজমিনে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পূর্বে রিয়াজ পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করে। সেখানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পরেন। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর রিয়াজও চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে নিজ এলাকায় চলে আসেন।
এলাকায় এসেই তিনি ভিন্নরূপ ধারণ করেন। থানা পুলিশের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে শুরু করেন দহরাম-মহরাম। তারই ধারাবাহিকতায় বাড়ির লোকজনকে সায়েস্তা করতে মরিয়া হয়ে উঠে রিয়াজ। তার কূটকৌশলে মোঃ নশু ঘরামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম ঘরের সন্তানদের ভাগিয়ে নেন। এবং এই মামলার মীমাংসা করে দিতে আসামীপক্ষের কাছে ৫০ লাখ টাকা এবং ৬০ শতাংশ জমি দাবি করে আসছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মামলার পর এসআই সোহেল রানার তাড়া খেয়ে আসামীরা আত্মগোপনে চলে গেলে সেই সুযোগ রিয়াজের নেতৃত্বে নশু ঘড়ামিগংদের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ৩৫টি চাম্বুল গাছ ও ৮০ শতাংশ জমির ধান কেটে নিয়ে যায় রিয়াজ। এমনকি পুকুরের লক্ষাধিক টাকার মাছ লুট করাসহ নশু ঘড়ামির নির্মিত একটি টিনের ঘর দখল করেন তিনি। যার প্রেক্ষিতে নশু ঘড়ামি একটি মামলা দায়ের করেন।
(যার মামলা নং-৪৩৪/২৫)। জানা গেছে, মৃত আমেনা বেগমের প্রথম স্বামী ধলা মিয়া ঘড়ামি মারা গেলে অসহায় ছেলে-মেয়েদের দেখভাল করার জন্য ছোট ভাই নশু ঘড়ামি আমেনা বেগমকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং তাদের বসবাসের জন্য একটি ঘর তুলে দেন। যা কাল হয়ে দাঁড়ায় নশু ঘড়ামির জন্য। এ ব্যাপারে মামলার ১নং আসামি বৃদ্ধ নশু ঘড়ামি মেডিকেল রিপোর্টের উপর শুনানী শেষে এ নাটকীয় মিথ্যা মামলা থেকে সকল আসামির অব্যাহতি দানে আদালতের বিচারকের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
এ বিষয়ে এসআই সোহেল রানা বলেন- ভাই (প্রতিবেদক) মামলা তদন্ত করতে গেলে নানা কথাই মানুষ বলে। আপনি (প্রতিবেদক) কোথায় আছেন, গলাচিপায় আসেন চা খাই। আমি বরিশাল আসবো, আপনার সাথে দেখা করে চা খাবো। এ বিষয়ে গলাচিপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুর রহমান বলেন- চার্জশিট প্রতিবেদনে তথ্য গরমিল থাকলে আসামীপক্ষকে আদালতে না রাজি দিতে বলেন। আর টাকা-পয়সার বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা।