More

    মুগডালের নামে বিক্রি হচ্ছে বিষাক্ত ‘মথবীজ’

    অবশ্যই পরুন

    বিদেশ থেকে আমদানি করা মথবীজে পাওয়া গেছে ক্যানসারের বিষাক্ত উপাদান টারট্রাজিন। রং মিশিয়ে যা মুগডাল হিসাবে সারা দেশের বাজারগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে। দেখতে মুগডালের মতো হওয়ায় ক্রেতা সাধারণ তাতে ক্ষতিকর বা বিষাক্ত কিছু আছে কিনা তা জানতে পারছেন না। কিন্তু তাদের পেটে যাচ্ছে ক্যানসারের বিষ। তারা পড়ছেন মৃত্যুঝুঁকিতে। সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরীক্ষায় ৩৩টির মধ্যে ১৮টি নমুনায় মেলেছে এই ভয়াবহ রাসায়নিকের অস্তিত্ব।

    বিএসটিআই নিশ্চিত করেছে-এই ডাল খাদ্য নয়, বরং ধীরে ধীরে শরীরে ক্যানসারসহ অন্যান্য রোগের ক্ষতিকর উপাদান ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বিপুল পরিমাণে এই ‘মথবীজ’ আমদানি হলেও বাজারে এই নামে কোনো পণ্যের বিক্রি নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) মুগডাল আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৯৬১ টন। অন্যদিকে ‘মথবীজ’ আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ৮৯১ টন।

    অন্যদিকে অ্যাসাইকুডা অনলাইন ডেটা পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছরে এইচএস কোড-০৭১৩৯৯০, ০৭১৩৩৯১০, ০৭১৩৩১৯০ এবং ০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মুগডাল আমদানি হয়েছে।

    আর এইচএস কোড-০৭১৩৯০৯০-এর আওতায় মথবীজ মুগডালের তুলনায় ১০ হাজার ৯৩০ টন বেশি আমদানি হয়েছে। বুধবার বিকালে রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছী এলাকায় ১২ টন রংযুক্ত মুগডাল জব্দ করা হয়েছে। ‘মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজ (ডাল ক্রাশিং অ্যান্ড সর্টিং মিল) ও মেসার্স পারভেজ এন্টারপ্রাইজ (ডাল অ্যান্ড সর্টিং মিল) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

    উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাহাতুল করিম মিজান ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শামীম আহমেদ বলেন, টারট্রাজিন বা হালকা হলুদ রং ২০০ পিপিএম পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু কাঁচা পণ্যে এসব রং ব্যবহারের কোনো ধরনের সুযোগ নেই। এসব রং কাঁচা পণ্যের ব্যবহার করা হলে খাবারের সময় সরাসরি মানবদেহে মিশে যায়। তা ছাড়া এসব রং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে বিশেষ করে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

    পাশাপাশি লিভার ও কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান ও শিশু পুষ্টি বিশেষজ্ঞ সিরাজাম মুনিরা যুগান্তরকে বলেন, টারট্রাজিন হলো এক ধরনের কৃত্রিম হলুদ রং, যা মূলত খাবারে আকর্ষণীয় রং আনার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি সিনথেটিক এবং অনেক দেশেই এটি নিয়ে সীমিত ব্যবহার বা সতর্কতার নির্দেশনা আছে। নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ না করেই আমাদের দেশে অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। যদি মথবীজে বা অন্য ডালে এই টারট্রাজিন রং মিশিয়ে খাওয়া হয়, তাহলে কিছু মানুষের শরীরে টারট্রাজিনে অ্যালার্জি হয়।

    এতে চুলকানি, র‌্যাশ, হাইভস এমনকি শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার উপসর্গ বাড়তে পারে। তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, টারট্রাজিনসহ কৃত্রিম রংগুলো শিশুদের আচরণে হাইপার অ্যাকটিভিটি (অতিসক্রিয়তা) বা মনোযোগের সমস্যা তৈরি করতে পারে। সরাসরি প্রমাণ না থাকলেও, কিছু গবেষণায় এগুলো ক্যানসারের কারণ হতে পারে। তাই অনেক দেশেই এর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা আছে। যা আমাদের দেশে নেই। কেজিতে ৩০-৫০ টাকা বেশি দাম পাওয়ার আশায় এই প্রতারণা : রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুদি দোকানে প্রতি কেজি মুগডাল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা।

    আর বিক্রেতারা জানায়, আমদানিকৃত আরেকটি মুগডাল (রং মিশ্রিত মথবীজ) যা কেজিপ্রতি ১৩০ টাকা হওয়ার কথা। বিক্রেতারা জানান, বাজারে দুই ধরনের মুগডাল পাওয়া যায়। ক্রেতা জানেন না, কোনটা আসল আর কোনটা নকল। তবে কম দামের এ ডাল দেখতে অনেক উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। ফলে অনেক বিক্রেতা লাভ বেশি করতে দুই ডাল একই দামে বিক্রি করে দেশের মানুষের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করছেন।

    কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, দেশের প্রতিটি মানুষ ভাতের সঙ্গে ডাল খান। এখানে ‘মথবীজ’কে ক্ষতিকর রাসায়নিক রং মিশিয়ে ‘ডাল’ হিসাবে বিক্রি করা হলে সেটা সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা। ইচ্ছাকৃতভাবে মানবদেহে বিষ ঢুকিয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

    এটি একটি বড় ধরনের অপরাধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎক্ষণাৎ কড়া তদারকি চালিয়ে অপরাধীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এদিকে মুগডালের তুলনায় মথবীজ আমদানির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হলেও দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে ৩৩টি নমুনা সংগ্রহের সময় বাজারে ‘মথ’ নামে কোনো ধরনের ডালের অস্তিত্ব পায়নি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পরীক্ষায় ১৮টি নমুনার মধ্যে হলুদ রংয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। রং মিশ্রিত ডালের একটি নমুনা বিএসটিআইর ল্যাবরেটরিতে পাঠালে পরীক্ষা করার পর ওই নমুনায় টারট্রাজিন নামক বিষাক্ত রং পাওয়া যায়।

    যা মানুষের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই ক্যানসার, লিভার ও কিডনির মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। পাশাপাশি খাদ্য-সংযোজন দ্রব্য ব্যবহার প্রবিধানমালা ২০১৭ অনুযায়ী, টারট্রাজিন রং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহারযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুগডাল ও ‘মথবীজ’ আমদানির ক্ষেত্রে রং পরীক্ষা নিশ্চিত করা ও রং মিশ্রিত ডাল আমদানি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে নিরাদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) জাকারিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘মথবীজে’ রং মিশিয়ে আমদানির ঘটনায় ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আমদানি বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

    তিনি জানান, কারা এই বিষাক্ত বীজ দেশে আনছে তা খুঁজে বের করতে তথ্য সংগ্রহ চলছে। জাকারিয়া স্পষ্ট করে বলেন, ডাল বা অন্য কোনো শস্যে রং ব্যবহারের কোনো অনুমোদন নেই। খাবারের পণ্যে এমনটি করলে তা সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। তাই আমদানির সময় ‘মুগ ও মথ’ ডালের রং পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং রং মিশ্রিত ডাল যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ‘মথ’ ডালের তুলনায় মুগডাল দ্বিগুণ পরিমাণে আমদানি হলেও বাজারে ‘মথ’ নামে কোনো ডাল পাওয়া যাচ্ছে না।

    স্থানীয় বাজারে মুগডাল নামে বিক্রীত ডালের সংগৃহীত নমুনার অধিকাংশেই রং মিশ্রিত। অনুমোদনবিহীন কোনো রং খাদ্যে ব্যবহার বা অনুপযুক্ত রং মিশ্রিত খাদ্য আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ ও বিক্রয় নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর ২৭ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য ব্যবসায়ীদের রংযুক্ত ডাল আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুত, সরবরাহ ও বিক্রয় থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষেরে নির্দেশে ‘মথ’ ডালের অস্তিত্ব খুঁজতে মাঠে নামেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

    গত কয়েকদিন রাজধানীর রহমতগঞ্জ, কাওরান বাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মথ ডালের কোনো অস্তিত্ব পাননি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। রং মিশিয়ে মুগডাল নামে বিক্রি করছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আছে অর্ধশত ডালের আড়ত। এখানকার ব্যবসায়ীরা ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ডাল আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করছেন।

    তবে বেশির ভাগ ডাল আনা হচ্ছে ভারত থেকে। আড়তগুলোর সামনে সাজিয়ে রাখা অধিকাংশ মুগডাল আসলেই মুগডাল নয়। গোমর ফাঁস হয় অধিদপ্তরের অভিযানে। প্রায় প্রতিটি আড়তেই অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটির কর্মকর্তারা। দেখা যায়, মুগডাল পানিতে ভেজালেই হলুদ রং ছাড়ছে। এতে গত কয়েক দিনে সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ১০ লাখ টাকার উপরে জরিমানা করেছে।

    জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, অধিদপ্তরের নির্দেশে দেশের প্রত্যেক অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা যেখানেই ডালে রং পাচ্ছেন, সেখানেই আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ভোক্তার স্বার্থে এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    ভোলায় নলকূপ খনন করলেই বেরিয়ে আসছে গ্যাস

    ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কয়েকটি গ্রামে নলকূপ খনন করলেই বেরিয়ে আসছে গ্যাস। সেই গ্যাস দিয়েই স্থানীয়রা বিনা খরচে রান্না করছেন...