More

    বরিশালে কিটনাশক দিয়ে নদীতে মাছ শিকার, নীরব প্রশাসন!

    অবশ্যই পরুন

    বরিশালে বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় মাছের পরিমাণ। নদ-নদীগুলোতে নির্বিচারে ক্ষতিকর গ্যাস ট্যাবলেট বা রাসায়নিক কিটনাশক ব্যবহার করে শিকার করা হচ্ছে দেশি মাছ। নির্বিচারে এভাবে মাছ শিকার করছে এক শ্রেণির অসাধু জেলে ও নদী পাড়ের মানুষ। এতে মাছসহ জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। গ্যাস ট্যাবলেট বা কিটনাশক দিয়ে শিকার করা মাছ বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন হাটবাজারে। বিষাক্ত জীবাণু আক্রান্ত এসব মাছের ক্ষতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে।

    তবে প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অবাদে মাছ শিকার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বরিশাল সদর উপজেলার চারবাড়ীয়া ইউনিয়নের চরআবদানী, লামছড়ী, কদমতলার চর, বোর্ডস্কুল, ভাঙ্গারপার, তালতলী, চরমোনাই ইউনিয়নের পসুরিকাঠী, খোন্নারেরচর, গিলাতলি, কালিগঞ্জ, অন্তরাঘাট, বুখাইনগর, সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের রামকাঠী, পানবাড়ীয়া, কামারপাড়া, আমিরগঞ্জ, চাঁদপুরা, চন্দ্রমোহন, নেহালগঞ্জ, গোমা, কাটাদিয়া, মিয়ারহাটসহ সদর উপজেলার নদীবেষ্টিত এলাকায় চলছে ভয়াবহ এক অপরাধমূলক কার্যক্রম। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি কীটনাশক নদী-খাল-বিলে ছিটিয়ে মাছ ধরছে একটি অসাধু চক্র।

    গ্রাম্য ভাষায় “জোবা” বা নদীর পানির স্তর কিছুটা কমলেই স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি, এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছাত্রছায়ায় দল বেঁধে নদীতে এই বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরছে। প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে এবং ভোরের দিকে এই কর্মকাণ্ড চলে, আর সকালে নদীর তীরে দেখা যায় ভাসমান মৃত মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙসহ নানা জলজপ্রাণী। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি এই কীটনাশকে রয়েছে Lambda Cyhalothrin 10% EC নামের মারাত্মক বিষাক্ত উপাদান।

    এটি পানিতে মিশে গেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাছ, চিংড়ি, ব্যাঙ, এমনকি পানির শৈবাল পর্যন্ত মারা যায়। ফলে নদীর প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এই রাসায়নিক পদার্থ মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং লিভারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নদীর পানি থেকে এসব বিষ নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি ও চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নগরীর হাটখোলাসহ যেসব দোকানে এই ধরনের কীটনাশক বিক্রি করা হয়, তারা অধিক মুনাফার আশায় এসব অসাধু ব্যক্তিদের কাছে মৌখিকভাবে পরামর্শ দেয় “কোন কীটনাশকের কত মিলি দিলে কত পরিমাণ মাছ মারা যাবে।” এমন ভয়াবহ ব্যবসায়িক কৌশলে বিক্রেতারা কীটনাশকের বাজার গরম রাখছেন, আর নদীগুলো হয়ে উঠছে মৃত্যুকুপ।

    বিশেষজ্ঞদের মতে, বিক্রেতাদের এই কর্মকাণ্ড ‘The Pesticides Ordinance, 1971’ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে। আইন অনুযায়ী, লাইসেন্সধারী বিক্রেতা যদি কোনো কীটনাশকের অপব্যবহার উৎসাহিত করেন, তবে তার বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল, জরিমানা এবং কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী- কোনো নদী বা জলাশয়ে রাসায়নিক বা বিষাক্ত পদার্থ ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

    একইভাবে মৎস্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ (সংশোধিত ২০০২) অনুযায়ী বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরলে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণেই এই ভয়াবহ অপরাধ এখন জন সম্মুখেই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন অভিযান না হওয়ায়, প্রকৃত দোষীরা থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য সুরক্ষার ছায়ায়।

    চরমোনাইর রুবেল নামের এক বাসিন্দা বলেন, “রাত হলেই নদীতে বিষ ছিটায়ে চিংড়ি তোলে। আমরা প্রতিবাদ করলে বলে- ‘উপর মহলের লোকেরা আছে পিছে’। প্রশাসনও কিছু করে না।” দেশে এখনই সময় এসেছে মারাত্মক বিষাক্ত কীটনাশকগুলো বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার। কৃষিতে সীমিত প্রয়োগ হলেও, এসব রাসায়নিকের অবাধ বাজারজাতকরণ এখন জনজীবন, মাছের প্রজনন, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানি পর্যন্ত দূষিত করছে। সরকারের উচিত দ্রুত এই ধরনের কীটনাশকের আমদানি, বিক্রি ও মৌখিক প্রচার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা এবং নদী ও জলাশয় রক্ষায় একটি কঠোর জাতীয় অভিযান পরিচালনা করা। নদীতে যদি বিষ ঢালা হয়, তাহলে জীবনও একদিন বিষে ডুবে যাবে।

    সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ জামাল হোসাইন বলেন- “নদীতে কীটনাশক ব্যবহার করে চিংড়ি ধরা একটি গুরুতর অপরাধ। এটি পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি তদন্ত করছি। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুদ্দীন বলেন- “নদীতে কীটনাশক ফেলে চিংড়ি ধরা শুধু আইনভঙ্গ নয়—এটি সরাসরি পরিবেশ হত্যা।

    এই ধরনের কর্মকাণ্ড পানি, মাছ এবং নদীর সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়। আমরা ঘটনাটি গুরুতরভাবে দেখছি। দায়ীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউই ছাড় পাবে না।”

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    আইটি ব্যবসার আড়ালে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে সিসার কারবার

    আইটি ব্যবসার আড়ালে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছিল নিষিদ্ধ মাদক সিসা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ক্রেতা সেজে চক্রের হোতাসহ...