সুমন দেবনাথ, বানারীপাড়া(বরিশাল) প্রতিনিধি: পিরোজপুরের নেছারাবাদ(স্বরূপকাঠি) উপজেলার কয়েকটি চরে সুন্দরী কাঠ ও গোলপাতার সর্ববৃহৎ ভাসমান বাজার হিসেবে এক সময়ে পরিচিত ছিল। বিক্রির জন্য গোলপাতা ও সুন্দরী কাঠ সন্ধ্যা নদীতীরবর্তী উপকূলে জেগে ওঠা চরে চলতোকিন্তু রমরমা ব্যাবসা। কালের বিবর্তনে সুন্দরী কাঠের দুষ্প্রাপ্যতা এবং গোলপাতা ব্যবহারের স্বল্পতার কারণে থমকে পড়ে বিশাল আকৃতির ভাসমান বাজারের রূপরেখা। শুরু হয় দেশীয় কাঠের ভাসমান বাজার।
ঐতিহ্যবাহী এই ভাসমান কাঠবাজারের ইতিহাস ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের। একসময় এই ব্যাবসা ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার অন্যতম বড় অবলম্বন। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে কাঠ ব্যবসায়ী ও বাজারসংশ্লিষ্টরা ভালো নেই। পরিবহন সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব ও পাইকারি ক্রেতার অভাবসহ নানা সংকটে আজ হুমকির মুখে দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজার।

নেছারাবাদ থানাসংলগ্ন সন্ধ্যা নদীর শাখা, সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনের খালের চর, ইন্দেরহাট খালের মোহনা, মিয়ারহাট বাজারের খাল ও বয়াসহ নানা স্থানে গড়ে ওঠা ভাসমান বাজারটি এখন নেছারাবাদের সব থেকে বড় কাঠ ব্যাবসাকেন্দ্র। এ ব্যাবসার মাধ্যমে এখানে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এই বাজারকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
এটি দক্ষিণ অঞ্চলের তথা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাঠের বাজার। সর্ববৃহৎ কাঠের বাজার হওয়া সত্ত্বেও এখানে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঠের চরের হাটে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ীরা সহজ ও স্বল্প লভ্যাংশ ব্যাংকিং সুবিধা না পাওয়া, ব্যবসায়ী নামে দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুদের আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বৃক্ষ বিনাশসহ নানা কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ব্যাবসা ঐতিহ্য ক্রমে বিলীনের পথে।
জানা যায়, আনুমানিক ১৯১৭ সালের প্রথম দিকে পিরোজপুর এলাকার তৎকালীন বাকেরগঞ্জের আওতাধীন বর্তমান নেছারাবাদ উপজেলায় সুন্দরবনের সুন্দরী গাছকে কেন্দ্র করে কাঠ ব্যাবসার যাত্রা শুরু হয়। ১৯১৮ সালের শেষদিকে নেছারাবাদের সন্ধ্যা নদীর তীরঘেঁষে একাধিক শাখা খালে গাছ বেচাকেনার জন্য ভাসমান কাঠের হাট গড়ে ওঠে। সুন্দরী কাঠ ব্যবসায় সরকারের বাধা নিষেধের পর থেকেই নেছারাবাদে গড়ে ওঠে মেহগনি, চম্পল ও রেইনট্রিসহ নানা দেশীয় কাঠের বৃহত্তর কাঠ বাজার।

প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা উপজেলার কাঠ মোকামগুলোর কাছ থেকে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার কাঠ কিনেন। আর এসব মালামাল ট্রাক, লঞ্চ ও কার্গোসহ বিভিন্ন পরিবহনে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান স্ব স্ব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পরিবহন সংকট ও পাইকারি ক্রেতার অভাবে সরবরাহ করা কাঠ নিয়ে প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ীরা। সময়মতো পরিবহন সংকটে গাছ বিক্রি বন্ধ থাকায় ঋণের বোঝা দিন দিন ভারী হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
নানাবিদ প্রতিকূলতার মধ্যেও বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, মুলাদী, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাগেরহাট ও হবিগঞ্জসহ দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখনো স্বরূপকাঠির এই ভাসমান কাঠের হাটে ব্যবসায় জড়িত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাঠের মোকাম গড়ে তুলছেন। নদীপথে দূর থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ীরা জলদস্যুদের ভয়ে ২৫-৩০টি নৌকার বহরে একই সঙ্গে স্বরূপকাঠির মোকামে আসে।
কাঠ বেচাকেনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা একই সঙ্গে চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া আবার গল্প-গুজব করেন। যে যার মতো বেচাকেনা শেষে, আবার সারিবদ্ধ নৌকাগুলো নদীপথে চলে যায়। নেছারাবাদের কাঠ ব্যবসায়ী মতিউর রহমান মৃধা বলেন, একটি গাছ চূড়ান্তভাবে ব্যবহারের আগে ৫-৬ বার বেচাকেনা হয়। দাঁড়ানো গাছ কাটা থেকে ব্যবহারের পর্যায় পর্যন্ত ৮ ধরনের শ্রমিক রয়েছে।

কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির কাছে এই কাঠ ব্যাবসার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, দেশের বড় চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ব্যাবসা-বাণিজ্য করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাবসা ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে অন্য কোনো কাজকর্মে চলে যেতে হবে। বর্তমানে কাঠের দাম অনুযায়ী ব্যবসা করা যাচ্ছে না। এদিকে উপজেলার কাঠ ব্যাবসার প্রচার ও প্রসার দেশজুড়ে পরিচিত লাভ করায় এ ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে কাঠ ব্যবসার সঙ্গে জড়াচ্ছে শিক্ষিত বেকার যুবকরাও।
তারা বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এ ব্যবসায় শুরু করে পরিবার নিয়ে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছিল। নানান প্রতিকূলতার কারণে কাঠ বাজারে ক্রেতা না থাকায় মহাশঙ্কায় পড়েছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন যুবক ব্যবসায়ী জানান, ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। ঋণের চাপে রাতে বাসায় থাকতে পারছি না।
ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠেছে আমাদের ঋণের বোঝা। সরকার যদি স্বল্প সুদে আমাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে ঋণের বোঝা কাটিয়ে ব্যাবসার পরিধি বাড়াতে পারতাম। দেড়শ বছরের পুরানো পিরোজপুরের নেছারাবাদ কাঠ বাজার। অবকাঠামো কিংবা আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য এখানে বিক্রি হয় প্রয়োজনীয় সব ধরনের কাঠ। নদী পথে ট্রলারে সরবরাহ হয় দূর দূরান্তে।
এই বাজারে কর্মব্যস্ত সময় পার করেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। অন্য দিনের চেয়ে হাটবারে হয় বেশি বেচাকেনা, পরিমাণ কোটি টাকার বেশি। কাঠ বাজারের আড়তদার মো. মাসুদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাই কাঠ কিনতে এখানে আসেন। এটি শত বছরের পুরোনো ব্যাবসা। কাঠের সহজলভ্যতাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ক্রিকেট ব্যাট ও ফার্নিচারের জমজমাট ব্যবসা। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান।
