জাটকা নিধন নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলে এবং ভিজিএফ সহায়তা বাবদ দেয়া সরকারি চাল উদ্ধার হয়েছিল বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরে আলমের গোডাউন থেকে।ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে উদ্ধার হওয়ার পর সরকারি চাল আত্মসাতের ওই ঘটনায় মামলাও দায়ের হয় তখন। কিন্তু তাকেই আবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।কেবল নূরে আলমই নয়, বরিশালে আগামী ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন ইউনিয়নে এমন কয়েকজনকে দলের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে; যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সরাসরি দুর্নীতি আর চাঁদাবাজির অভিযোগ।এসব অভিযোগে মামলা দায়ের হওয়ার পাশাপাশি হয়েছে সংবাদ সম্মেলন। এমনকি মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন একজন রয়েছেন যিনি সরাসরি টেলিফোন আলাপে স্বীকার করেছেন ঘুষ-দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি। টেলি আলাপনের সেই রেকর্ড ভাইরাল পর্যন্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে দুষ্ট এসব চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগগুলোকে অবশ্য খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নন জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা।
জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সাবেক এমপি অ্যাভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসের ভাষায়- আদালত কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার আগে কাউকেই অপরাধী বলা যাবে না। যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কেউই সেই অর্থে এখন পর্যন্ত অপরাধী নয়। আদালত যদি কখনো তাদের দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন তো তখন বিষয়টি দেখা যাবে।জেলা সম্পাদক এভাবে বললেও অবশ্য এসব চেয়ারম্যানের আবারো দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ আর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে। এরই মধ্যে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ হয়েছে উজিরপুরে। হিজলাতেও হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ।বাবুগঞ্জের কেদারপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নূরে আলমের গোডাউন থেকে সরকারি চাল উদ্ধারের ওই ঘটনাটি ঘটে গত বছরের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। কেবল চেয়ারম্যানই নয়, সেখানকার দুই ইউপি সদস্যের হেফাজত থেকেও তখন উদ্ধার হয় ত্রাণের চাল।
সেই ঘটনায় ওই দুই ইউপি সদস্য রোকনুজ্জামান এবং জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।চেয়ারম্যান নূরে আলমের পাশাপাশি এই দুই ইউপি সদস্যও আবার তাদের নিজ নিজ দল থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জোর গুঞ্জন চলছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে পুরো বাবুগঞ্জ উপজেলায়।দুর্নীতির দায়ে দুষ্ট চেয়ারম্যানকে আবারও দলীয় মনোনয়ন দেয়ার জন্য কেন উপজেলা কমিটি নাম সুপারিশ করে পাঠাল জানতে চাইলে বাবুগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী ইমদাদুল হক দুলাল বলেন, তৃণমূলের সমর্থন অনুযায়ী তার নাম জেলায় পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে কে কোন দোষে দুষ্ট তা দেখার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।গত বছরের ৯ আগস্ট বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে চাঁদার দাবিতে একটি পরিবহনের কাউন্টারে হামলা, ভাংচুর এবং কয়েকজনকে বেদম মারধরের ঘটনায় মামলা দায়ের হয় বরিশাল সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন লিটন মোল্লার বিরুদ্ধে। কেবল এই একটিই নয়, এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে একাধিক মামলা।চাঁদাবাজির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পরিপ্রেক্ষিতে জেলহাজতে গেলে চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সবাই ধারণা করেছিল যে নানা দোষে দুষ্ট লিটন মোল্লা হয়তো আর পাবে না আওয়ামী লীগের সমর্থন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই লিটন মোল্লাই আবার পেয়েছেন কাশিপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।
প্রায় একইরকম ঘটনা ঘটেছে বাকেরগঞ্জ উপজেলার গাড়ুরিয়া ইউনিয়নে।
এখানে বর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার হায়দার। দায়িত্ব পালনকালে এই জুলফিকারের বিরুদ্ধে টিউবওয়েল দেয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া এবং ভিজিডিসহ ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন তারই পরিষদের দুই সদস্য মো. আলাউদ্দিন এবং পাপিয়া জেসমিন।মামলা দায়েরের পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরা হয় তার নানা অনিয়ম দুর্নীতির ফিরিস্তি। মামলা করায় ইউপি সদস্যসহ বেশ কয়েকজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেন জুলফিকার। সেই ঘটনায় জিডি হয় তার বিরুদ্ধে।এতসব ঘটনার পরম্পরায় আগামী নির্বাচনে তিনি আর মনোনয়ন পাবেন না- এমনটাই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু তার ওপর আবারো আস্থা রেখেছে আওয়ামী লীগ। এবারো দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাকে।বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে জুলফিকার জানান, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ষড়যন্ত্রের কারণে এসব মামলা ও জিডি হয়েছে। আদালতেই প্রমাণ হবে যে আমি দোষী নাকি নির্দোষ।দুর্নীতি প্রশ্নে উল্লেখিত জনপ্রতিনিধিদের কর্মকা- এখনও বিচারাধীন পর্যায়ে থাকলেও নিজেই নিজের মুখে সদস্যদের কাছ থেকে উৎকোচ আদায় এবং তা বিভিন্ন পর্যায়ে বণ্টনের বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের বেবী রানী হালদার। গত মাসে বেবী রানী এবং তার ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য দিপালী হালদারের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হলে বেরিয়ে পড়ে বিষয়টি।১৯ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে সদস্যদের কাছ থেকে বেবী রানী হালদারের লাখ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণ এবং তা বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে বাটোয়ারার প্রমাণ মেলে। একই সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকা-ে অনিয়ম দুর্নীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও ফাঁস হয় ওই মোবাইল আলাপনে। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় ব্যাপক তোলপাড়ও হয় পুরো বরিশালে।
একেবারে কাছাকাছি সময়ের ওই ঘটনার পরও বেবী রানীকে আবারও দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ ঘটনায় জল্লা এলাকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শনিবার সেখানকার সানুহার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন কয়েকশ’ নারী-পুরুষসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ করে বেবী রানী হালদারের মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানান তারা।এছাড়া হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দেয়া মনোনয়নের বিরুদ্ধেও হয়েছে বিক্ষোভ। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় শুনেই ফোন কেটে দেন বেবী রানী।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, অভিযোগ উঠা আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া এক নয়। এদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যাবে না। সেই বিবেচনার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থনের বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যদি কখনো অভিযোগ প্রমাণিত হয় তখন দেখা যাবে।