স্টাফ রিপোর্টারঃ চারটি আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জেতাতে মাঠে নেমেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
আসনগুলো হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ), পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া), রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) ও কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া)। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে সমঝোতার কারণে প্রথম তিনটি আসনে জাপাকে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নেই, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা রয়েছেন। আর কিশোরগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন।
স্থানীয় দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এসব আসনে জাপা ও বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থীদের পক্ষে আওয়ামী লীগের অনেকে মাঠে নেমেছেন অনেকটা চাপের মুখে। কোন পর্যায়ে থেকে চাপ এসেছে, এ নিয়ে স্বনামে মন্তব্য করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট নেতারা।
এবারের নির্বাচনে জাপাকে ২৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে একটি আসন হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২। সমঝোতার কারণে এই আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শাহজাহান আলম মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তিনি গত নভেম্বরে ওই আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
এই আসনে জাপার প্রার্থী হলেন দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। এখানে তাঁর শ্বশুর জিয়াউল হক মৃধা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। জিয়াউল হকও জাপার নেতা ছিলেন, রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি জাপা থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন।
মঈনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ আসে জাপার বহিষ্কৃত নেতা জিয়াউল হক মৃধার পক্ষে মাঠে নামার জন্য। কোনো কোনো মহল থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের এমনও বলা হচ্ছে যে জিয়াউল হককে জেতাতে ওপরের মহলের নির্দেশনা আছে।
এরই মধ্যে জিয়াউল হকের পক্ষে সক্রিয় হয়েছেন সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর ও তাঁর ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ঠাকুর। সাইফুল বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে স্বীকারও করেছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পক্ষে বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং ইউপি চেয়ারম্যানরা যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের প্রশাসনের লোকজন ডেকে নিয়ে একবার বলছেন লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে। এখন আবার বলছেন জিয়াউল হকের (প্রতীক-ঈগল) পক্ষের কাজ করতে। এসব নির্বাচনী আচরণবিধিপরিপন্থী কাজ।’
সরাইলের একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানও নাম না প্রকাশের শর্তে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা একটি মহলের নির্দেশনায় মঈন উদ্দিনের পক্ষ থেকে সরে এসেছেন।
জিয়াউল হক মৃধা নিজেও প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাঁর পক্ষে কাজ করছে।
জাপার সঙ্গে সমঝোতার কারণে পিরোজপুর-৩ আসন থেকেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরিয়ে নিয়েছে। এখানে জাপার প্রার্থী দলীয় চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মো. মাশরেকুল আজম।
এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী। এবার তাঁর দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া প্রসঙ্গে জাপার সূত্র বলছে, তিনি সংসদ অধিবেশনে সব সময় সরকারের পক্ষে কথা বলতেন। বিষয়টি জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব পছন্দ করত না।
জাপার মনোনয়নবঞ্চিত রুস্তম আলীর পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। গত মঙ্গলবার রুস্তম আলীর পথসভায় বক্তব্য দেন গুলিসাখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরিফ উল হক, সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল আলম, মঠবাড়িয়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ ব্যাপারী, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবু হানিফ খান ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবু হানিফ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় কোনো প্রার্থী নেই। দলীয়ভাবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তাই বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীর পক্ষে কাজ করছি।’
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আশরাফুল রহমান। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি সরে দাঁড়ালেও তাঁর বড় ভাই শামিম শাহনেওয়াজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর পক্ষেও ক্ষমতাসীন দলের একটা অংশ ভোটের মাঠে রয়েছে। এই অংশের নেতাদের অভিযোগ, রুস্তম আলী ফরাজীকে জিতিয়ে আনতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওপর চাপ রয়েছে।
রুস্তম আলী ফরাজী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চারবারের সংসদ সদস্য। তাই তাঁর পক্ষে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আরেকটি আসন রংপুর-১-এ জাপার প্রার্থী হলেন জি এম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। এই আসনের বর্তমান সংসদ সংসদ সদস্য মসিউর রহমান (রাঙ্গা) জাপার মনোনয়ন পাননি, কয়েক মাস আগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
জাপা সূত্র জানায়, মসিউর রহমানের প্রতি সরকারের উচ্চ মহলের সুনজর আছে। তাঁর পক্ষে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন মসিউরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মমিনুর রহমান।
বিএনপির বহিষ্কৃত নেতার পক্ষে আ.লীগ
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ। কিন্তু কয়েক দিন ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামানকে সমর্থন দেওয়া শুরু করেন।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত মন্তব্য করে কয়েক দফা দলটি থেকে বহিষ্কৃত হন আখতারুজ্জামান। তাঁকে গত রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেন এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ।
নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল কাহারের চেয়ে আখতারুজ্জামানকে ভালো মনে হয়েছে তাঁর।
অবশ্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল কাহার আকন্দ মনে করেন, নূর মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়ে অন্য প্রার্থীকে সমর্থন দিতে পারেন না।