সংরক্ষিত বনকে ঘিরেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পসার। বেলাভূমিতে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখার পাশাপাশি পর্যটন আকর্ষণের পেছনেও ছিল বনভূমি ও নারিকেল বাগান। এখনও নারিকেল বাগান, ঝাউবন, ইকোপার্ক, লেম্বুরবন, গঙ্গামতি, চর গঙ্গামতির বনাঞ্চলই দর্শনার্থীদের পছন্দের শীর্ষ। তবে বাস্তবে এসব বনাঞ্চল বিলীনের পথে। যেসব এলাকায় গাছপালা আছে, সেখানেও কুঠার চালাচ্ছেন স্থানীয় কিছু লোক।
সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রের তাণ্ডবেও বিপুল পরিমাণ গাছপালা উজাড় হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বনের গাছ কেটে উজাড় করা হলেও প্রশাসন একরকম নীরব। এই সুযোগে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একাধিক চক্র বনে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, লোকবল সংকটের কারণে বন উজাড় ঠেকাতে পারছেন না তারা। সম্প্রতি কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের লেম্বুরবন, গঙ্গামতি, চর গঙ্গামতি এলাকায় ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। অধিকাংশ এলাকায়ই গাছ কেটে, মাটি কেটে বন ধ্বংস করা হচ্ছে। এর বিপরীতে বন বিভাগের কর্মকাণ্ড তেমন নেই বললেই চলে। কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও তুলেছেন তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৈকতের ভাঙন ঠেকানো ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা খরচে ২০০৫ সালে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে কুয়াকাটা ইকোপার্ক নির্মিত হয়।
২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর সেটির নাম দেওয়া হয় কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। ১৫ বছরের মধ্যেই সেই উদ্যানটি প্রায় বিলীন। যে অংশ এখনও টিকে আছে, সেখান থেকেও গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অনেক সময় সমুদ্রতীর ভাঙনের ফলে গাছের গোড়া থেকে বালু ক্ষয় হলে গাছ হেলে পড়ে। এসব গাছগুলো নিলামে তোলা বা কেটে নেওয়ার নিয়ম নেই।
এসব গাছও দিনদুপুরে কেটে ফেলা হচ্ছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর রেঞ্জের আওতাধীন কুয়াকাটার খেজুরা থেকে গঙ্গামতি পর্যন্ত এলাকায় ২০২০ সালেও এক হাজার ৬০০ হেক্টর বন ছিল। কমতে কমতে যা ২০২৫ সালে এসে এক হাজার ১০০ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যেই ৫০০ হেক্টর বন বিলীন হয়ে গেছে। কলাপাড়ার রেঞ্জের আওতাধীন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সঠিক পরিমাণ তারা দিতে পারেননি।
সম্প্রতি চর গঙ্গামতির বনাঞ্চলে দেখা যায়, একটি জায়গা থেকেই কয়েকশ ঝাউগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছগুলোর গোড়া পড়ে আছে, পাশেই শুকিয়ে পড়ে আছে ডালপালা। স্থানীয়দের ভাষ্য, যেসব জেলে অবৈধ বেহুন্দি জাল নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে যান, তারাই ঝাউগাছ কেটে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে গঙ্গামতি এলাকার লেকের পাড়ে ৯ জন জেলেকে গাছ কাটতে দেখা যায়। তারা ঝাউগাছসহ অর্ধশতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে খুঁটি তৈরি করেন। পরে সেগুলো মাছধরার ট্রলারে উঠাচ্ছিলেন।
মো. সোবহান মাঝি নামের এক জেলেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমরা গাছ কাটি না, ডালপালা কেটে জালের খুঁটা বানাই। আর এগুলো কাটার আগে এখানে ফরেস্টার আছে, জাকির স্যার; তাঁকে বলে কাটি। স্যার ডালপালা কাটতে কইছেন, গাছ কাটতে নিষেধ করছেন।’ এলাকাবাসীর ভাষ্য, এক সময়ে এই বনে ঝাউগাছ, রেইনট্রি, আকাশমণি, জাম, রাম তেঁতুল, কেওড়া, গোমা (গেউয়া), সুন্দরী, শালসহ বিভিন্ন প্রকার গাছ ছিল।
এখন ঝাউগাছ ছাড়া অন্য প্রজাতির গাছ চোখেই পড়ে না। উপকূলীয় এই এলাকায় বছরে বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। লাখ লাখ মানুষের প্রাণরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংরক্ষিত বন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বন উজাড় হওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়েছে।
হোসেনপাড়ার বাসিন্দা আবদুল মোতালেব (৫৫) বলেন, ‘আমরা সাগর পাড়ের মানুষ। আমাদের জীবন, পরিবার, সবকিছুই সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো বন্যা (ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস) হয়েছে, তার সবগুলোতেই রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে বিশাল এই বন। এখন বেশির ভাগ এলাকার গাছ বিলীন হয়ে গেছে। ফলে জোয়ারের পানিও বন ভেদ করে লোকালয়ে চলে আসে।
বড় বন্যা হলে তো আর আমাদের রক্ষা নেই।’ এ কারণে উপকূলীয় মানুষের চাওয়া, বন ধ্বংসে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের সঙ্গে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত বলে অভিযোগ তাদের। দক্ষিণ মুসল্লিয়াবাদের বাসিন্দা মো. হযরত আলীর ভাষ্য, বাগানের গাছ কে কখন কাটতেন, এর খবর জানতেন মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। তিনি সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। এই কর্মকর্তা শুধু বন নয়, বনের মাটি বিক্রি করেও কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলেও দাবি করেন।
ওই রেঞ্জ থেকে পাঁচ মাস আগে রাঙ্গাবালী রেঞ্জে বদলি হওয়া আবুল কালাম আজাদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। রোববার সমকালকে তিনি বলেন, ‘আমি মহিপুরে থাকাকালীন সময়ে মাটি কাটা ও বন কাটার অভিযোগে ১৪টি মামলা করেছি। ১০টি মাটি কাটার ট্রাক জব্দ করেছি। চারজনকে জেলেও পাঠিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে টাকাপয়সা নেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা পুরোপুরি মিথ্যা।’
গঙ্গামতিসহ উপজেলার সংরক্ষিত বন ধ্বংস হলে শুধু গাছই নয়, উপকূলের প্রাকৃতিক ঢালও ধ্বংস হবে বলে মনে করেন পরিবেশকর্মী কে এম বাচ্চু। তিনি উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন (উপরা) নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়ক। কে এম বাচ্চু বলেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। গাছ কেটে ও মাটি কেটেই এর বেশির ভাগ ধ্বংস করা হচ্ছে।
চর গঙ্গামতি এলাকার ৫০-৬০ শতাংশ এলাকার গাছ কেটে চাষের জমি তৈরি করছে একটি মহল। নতুন করে ২০-৩০ শতাংশ গাছ কেটে নিচ্ছে। বন বিভাগ এসবের খোঁজ রাখে না অভিযোগ করে কে এম বাচ্চু বলেন, যখন কোনো সংবাদকর্মী বা স্থানীয় লোকজন এটা নিয়ে কথা বলেন, তখন মামলা দিয়ে কর্মকর্তা দায় সারেন।
সরকার যদি এই বনখেকো আর প্রশাসনের দিকে নজর না দেয়, তাহলে পুরো এলাকার পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়বে। লাখ লাখ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা দেখা দেবে। পর্যটনের সম্ভাবনাও নষ্ট হবে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান মিঞার মোবাইল ফোন নম্বরে সপ্তাহখানেক ধরে কয়েক দফায় কল দিলেও ধরেননি।
খুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি। মাস দুয়েক আগে মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্ব নেওয়া কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘যে ঝাউগাছগুলো কাটা হয়েছে, এগুলো আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে করছে। আমাদের লোকবল কম থাকায় অনেক সময় অভিযানে বেগ পেতে হয়।’
এই কর্মকর্তার দাবি, অভিযানে গেলে জীবন নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয়। কখনও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি পান। তারা বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন। সব শ্রেণির মানুষের সহায়তা পেলে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য তারা সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছেন।