সোমবার সন্ধ্যার পর সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার আকাশটা হঠাৎই বদলে গেল। পশ্চিমে ডুবছে সূর্য, পূর্ব দিগন্তে জেগে উঠছে ফানুসের আলো। একে একে উড়ে যাচ্ছে শত শত আলোকিত ফানুস। কারো লাল, কারো নীল, আবার কারো গায়ে সোনালি ঝিলিক। একটার পর একটা আলো আকাশে উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন তারারা হঠাৎ মাটিতে নেমে এসে আবার আকাশে ফিরে যাচ্ছে।
কোথাও কোথাও মাটিতেও খসে পড়ছে আগুনের ফুলকি। কিন্তু সে ভয় নয়, এ তো আনন্দের আগুন। এই আগুন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমার আনন্দ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সৈকতে দাঁড়িয়ে সেই আগুন দেখছেন। তাদের কেউ হাততালি দিচ্ছেন, কেউবা মোবাইল ফোনে ধারণ করছেন সেই দৃশ্য। রাত গভীর হলে দেখা গেল, সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপরে এখনো উড়ছে ফানুস।
যেন ছোট ছোট প্রার্থনা, আলো হয়ে ভাসছে আকাশপথে। সেই আলোয় মিশে আছে গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণী, মিশে আছে রাখাইনদের আনন্দ-দুঃখ, স্মৃতি ও আশার রঙ। কুয়াকাটার আকাশে যে আলো ছড়িয়ে পড়েছে, তা শুধু ধর্মীয় নয়, তা মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের। এই আলো সহাবস্থানের। বৌদ্ধদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এই শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আলো। তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাসের সমাপ্তি ঘটে এই পূর্ণিমায়।
বুদ্ধপূজা, সংঘদান, পিণ্ডদান, অষ্টপরিষ্কার দান, পঞ্চশীল প্রার্থনা, প্রদীপপূজা আর ফানুস ওড়ানো। এই সব মিলিয়ে রাখাইনপাড়াগুলো যেন উৎসবে ভরে উঠেছিল। সোমবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকেই কুয়াকাটার গোড়া আমখোলাপাড়া, কেরানীপাড়া, কালাচানপাড়া, বৌলতলীপাড়া, বেতকাটাপাড়া, নাচনাপাড়াসহ ২৮টি রাখাইন পল্লীর সব জায়গাতেই একই দৃশ্য।
দিগন্তজোড়া আকাশে জ্বলজ্বল করছে রাখাইন তরুণদের হাতে তৈরি ফানুস। কেউ বানিয়েছে ‘প্যারাসুট ফানুস’, কেউ ‘মালা ফানুস’, কেউ বা ‘লেস ফানুস’। প্রতিটির পেছনে লেগেছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। রাখাইনদের প্রবারণা উৎসব ঘিরে কুয়াকাটার প্রতিটি বৌদ্ধবিহার সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। বাতাসে বাজছে ঘণ্টার ধ্বনি, চারদিকে প্রদীপের আলো।
অতিথি আপ্যায়নে টেবিল ভরা কুকি, পাটিসাপটা, পাতাপিঠা, বিন্নি চালের পিঠা, ক্ষীর আর পায়েসে। রাখাইন নারীরা ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে, শিশুরা ছুটছে ফানুস হাতে। কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার রাখাইন মাতুব্বর উচু মং বলেন, ‘আমাদের এই উৎসব কালের বিবর্তনে এখন সর্বজনীনতার রূপ পেয়েছে। ধর্মের ভেতরে থেকেও এটি এখন মানুষে মানুষে আনন্দ ভাগাভাগির উৎসব।’ প্রবারণা পূর্ণিমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে কুয়াকাটা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ইন্দ্রমোহন ভিক্ষু।
তিনি বলেন, ‘এই পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মপ্রচার শুরু করেছিলেন। তাই এই রাতের ফানুসে ছড়িয়ে দেওয়া হয় অহিংসা, শান্তি ও কল্যাণের বার্তা।’ তবে সব আনন্দের মাঝেও আছে কিছু হাহাকার। বাংলাদেশ বৌদ্ধ-কৃষ্টি প্রচার সংঘের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সভাপতি নিউ খেইন বলেন, রাখাইন পাড়াগুলোর জনসংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আর্থিক অসচ্ছলতা আছে, সরকারি সহায়তাও যথেষ্ট নয়। ফলে আগের মতো ফানুস ওড়ানো এখন অনেকটাই কমে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাউসার হামিদ বললেন, ‘রাখাইনরা যেন নিরাপদে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি রাখাইন পাড়ায় দেওয়া হয়েছে ৫০০ কেজি করে চাল, বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা।’