আধা লিটার বোতলজাত পানির দামে আপনি এখন এক কেজি আলু পাবেন। আলুর দাম পড়ে গেছে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে বড় বিপণিবিতানগুলোয় ৫০০ মিলিলিটার বা আধা লিটারের যে পানির বোতল পাওয়া যায়, সেগুলোর দাম এখন ২০ টাকা। আর বাজারে খুচরা পর্যায়ে এক কেজি আলু বিক্রি হয় ১৮ থেকে ২০ টাকায়। অর্থাৎ আধা লিটার পানির দামেই পাওয়া যাচ্ছে এক কেজি আলু।
সাধারণত ‘পানির দামে’ বলতে খুব সস্তা দাম বা অত্যন্ত কম দাম বোঝায়। এখন এই রূপক অর্থই যেন সত্যি হলো। এতে আলুচাষিদের জন্য করুণ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ অনেকটা ‘পানির দামেই’ আলু বিক্রি করছেন আলুচাষিরা।
শুধু আধা লিটারের পানির বোতলই নয়; বাজারে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো সবজিও এত কম দামে কেনা যায় না। বর্তমানে সবচেয়ে সস্তা সবজির একটি হচ্ছে পেঁপে; সেটির কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। যেকোনো ধরনের এক আঁটি শাকের দামও ১৫ থেকে ২০ টাকা বা এর কাছাকাছি দামে বিক্রি হয়।
অথচ গত বছর অনেকটাই ভিন্ন চিত্র ছিল আলুর বাজারে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের এই সময়ে বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। এখন সেই দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর উৎপাদন এলাকায় খুচরা বাজারে ১৪ থেকে ১৫ টাকা দরেও আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন গুণের বেশি কমে গেছে।
লোকসানে কৃষকেরা
আলুর দাম কম থাকায় ক্রেতা, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা খুশি। তবে কৃষকেরা লাভ করতে পারছেন না। আলুর এমন দরপতনে উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। এ ছাড়া লোকসানে পড়েছেন আলু ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও।
সাধারণত দেখা যায়, যে বছর কৃষকেরা কোনো ফসল চাষ করে লোকসানে পড়েন, পরবর্তী বছর বা মৌসুমে ওই ফসল উৎপাদন কমিয়ে দেন তাঁরা। আগামী মৌসুমেও এমন পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশে বছরে আলুর চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। সরকারি হিসাবে, গত অর্থবছর মোট ১ কোটি ২৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৬ লাখ টন। অর্থাৎ আলুর উৎপাদন বেড়েছে। মূলত গত দু-তিন বছরে বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় আলু চাষ করে লাভবান হয়েছিলেন কৃষকেরা। এতে তারা গত মৌসুমেও আলু চাষ বাড়িয়ে দেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম পড়ে যায়।
দেশে আলুর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয় মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলায়। প্রতিটি স্থানেই আলুচাষিরা এবার কম দাম পেয়েছেন। যেমন সর্বশেষ মৌসুমে মুন্সিগঞ্জে এক কেজি আলু উৎপাদন ও হিমাগারে সংরক্ষণে মোট খরচ হয়েছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা। সেই আলু বিক্রি করে প্রতি কেজিতে তাঁদের হাতে থাকছে মাত্র ৫২ থেকে ৬৮ পয়সা। অনেক কৃষকের লোকসানও হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়নের হামিদপুর এলাকার কৃষক আহসান উল্লাহ সরকার প্রায় তিন দশক ধরে আলু চাষ করেন। গত মৌসুমে তিনি ১৩ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়েছেন বলে জানান তিনি।
আহসান উল্লাহ সরকার বলেন, ‘সর্বশেষ মৌসুমে আলুর আবাদ করে লাখ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সামনে আলুর আবাদ কিছুটা কমিয়ে ফেলার চিন্তা রয়েছে। আমার এলাকার অন্য যেসব কৃষক আলু চাষ করে লোকসানে পড়েছেন, তাঁরাও আলুর আবাদ কমিয়ে অন্য সবজি আবাদের চিন্তা করছেন।’
