নীলফামারীর সৈয়দপুরে হিমাগারে রাখা আলুর বাজারে ধস নেমেছে। উৎপাদন খরচ, পরিবহণ ব্যয় ও হিমাগার ভাড়া বহন করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ফলে আলু খাওয়ানো হচ্ছে গরুকে।
মৌসুমের শুরুতে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার আশায় হিমাগারে পর্যাপ্ত আলু মজুত করেন কৃষকরা; কিন্তু বর্তমানে বাজারে আলুর চাহিদা কম থাকায় দাম ক্রমেই কমে যাচ্ছে। যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে, তাতে খরচই উঠছে না বরং উল্টো বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ। গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে মজুত করা আলু। সৈয়দপুরের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর লাভের স্বপ্ন নিয়ে হিমাগারে ব্যাপক পরিমাণ আলু মজুত করেন। তবে এবার দাম না থাকায় স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে কৃষকের।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার জেলায় ১১টি হিমাগারে প্রায় ৯০ হাজার টন আলু মজুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার টন আলু বের করা হয়। বাজারে দাম কম থাকার কারণে বাকি আলু হিমাগারে পড়ে আছে। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও হিমাগারের আলু বের করছেন না সংরক্ষণকারীরা। কৃষকরা বলছেন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার যেন জরুরি ভিত্তিতে বাজার মনিটরিং বাড়ায় এবং হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর জন্য প্রণোদনা বা সহায়তা প্রদান করে।
হিমাগার ভাড়া, পরিবহণ খরচ ও শ্রমিক মজুরি যোগ করলে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা ব্যয় হয়। সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে। ফলে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৩ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুরের কৃষক জয়নাল আবেদীন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার আলুর বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা প্রতি বছর হিমাগারে আলু মজুত করি, কিন্তু এবার আলুর দাম একেবারেই কম। কেজিপ্রতি ১০ টাকা লোকসান হয়েছে।
৬০ কেজি আলু রেখে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৪০০ টাকা। আর বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়। সৈয়দপুরের বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের কৃষক রবিউল বলেন, সরকার নির্ধারণ করা মূল্যে বিক্রি না হয়ে বাজারে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের মজুত করা আলু বিক্রি করে লোকসান হচ্ছে; অপরদিকে ক্রয় করার তেমন ব্যবসায়ীও নেই। তিনি বলেন, লাভের আশা করে হিমাগারে আলু রেখেছিলাম কিন্তু এবার লোকসান হয়ে গেল।
অনেক টাকা খরচ করে আলু আবাদ করেছিলাম; যে ব্যয় হয়েছে সেটাও উঠছে না। সৈয়দপুরের বোতলাগাড়ির কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঋণ করে আলু রোপণ করেছিলাম। পরে হিমাগারে মজুত রেখেছিলাম ভালো দাম পাওয়ার আশায়; কিন্তু হয়েছে উল্টো। এবার আলুতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। সরকারের উচিত আলু রপ্তানিতে উদ্যোগ নেওয়া। এতে আলুর বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। কৃষকদের ক্ষতি অনেকটা লাঘব হবে। কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলুর দাম না থাকায় ২-১ বস্তা করে আলু হিমাগার থেকে বের করে গৃহপালিত গরুকে খাওয়াচ্ছেন।
উপজেলার বেশকিছু এলাকায় লোকজন গবাদিপশুকে আলু খাওয়াচ্ছেন। গত বছর আলুতে দাম মেলায় লাভবান হন কৃষক ও হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা ব্যবসায়ীরা। এবারও লাভের আশায় সৈয়দপুরের কয়েকজন সাংবাদিক স্থানীয় হিমাগারে আলু রাখেন।
বর্তমান বাজারে তারা পুঁজি হারাতে বসেছেন। এমন ধরা খাবেন চিন্তাও করেননি তারা। সৈয়দপুরের আলু ব্যবসায়ী হাজী টুনটুন বলেন, আমি ব্যবসায়িকভাবে কয়েক হাজার বস্তা আলু হিমাগারে মজুত করেছি। পরিবহণ শ্রমিকসহ কেজিপ্রতি প্রায় ১০ টাকা লোকসান হবে। আমার কয়েক হাজার বস্তা আলু হিমাগারে মজুত করা আছে- লোকসানের কারণে এখনো বের করিনি।
সৈয়দপুরের নর্দান কোল্ড স্টোরেজ, ইসমাঈল বীজ হিমাগার ও সাজেদা কোল্ড স্টোরেজের মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতি বছর আমাদের হিমাগারে কৃষকরা আলু মজুত করে রাখেন। গত বছর আলুর দাম ভালো থাকার কারণে সময়ের আগে আলু বের করেছে অনেক কৃষক। তবে এবার দাম না থাকায় হিমাগারে পড়ে আছে আলু।
এতে আমাদের লোকসানের পাশাপাশি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। কেউ লোকসানের কারণে আলু বের করছেন না। আমরা ইতোমধ্যে মাইকিং করে আলু বের করার জন্য বলেছি। কারণ সামনে নতুন আলু চলে এসেছে প্রায়। তাই এছাড়া কোনো উপায় নেই আমাদের। সৈয়দপুর কৃষি কর্মকর্তা ধীমান ভূষণ ও নীলফামারী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর ইসলাম বলেন, এ বছর জেলায় প্রায় ৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আলুর বীজ রোপণ শেষ হয়েছে, এর মধ্যে আগাম আলু রয়েছে। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই নতুন আলু বাজারে আসবে।
যদি দাম ভালো থাকে, কৃষকেরা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ বছর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ হাজার হেক্টর জমি। পরামর্শের জন্য মাঠপর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন বলে জানান তারা।
