More

    নদীর সঙ্গে লড়াই, জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম—শিক্ষা কি তবে বিলাসিতা?

    অবশ্যই পরুন

    মো. মিজানুর রহমান, গলাচিপা, পটুয়াখালী: দেশের উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোর নদীর তীর ঘেঁষে সারি সারি নৌকা। প্রতিটি নৌকাতেই বসবাস একটি করে পরিবার। সেই নৌকাই তাদের ঘর, সেই নৌকাতেই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সহাবস্থান। ধর্মে মুসলমান হলেও বিচিত্র জীবনযাত্রার কারণে তারা পরিচিত ‘মানতা সম্প্রদায়’ নামে। অনেকের কাছে তারা ‘অদৃশ্য’ বা ‘অজানা’ এক জনগোষ্ঠী—যাদের জন্ম, জীবন ও মৃত্যু নদীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

    ইতিহাস বলছে, মানতা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ গোষ্ঠীর ভাসমান জীবনের সূচনা দেড়শ থেকে দুশো বছর আগে। কোনো কোনো গোষ্ঠী তারও পুরোনো। শত বছর পেরিয়ে গেলেও তারা আজও পায়নি স্থায়ী কোনো ঠিকানা কিংবা এক টুকরো স্থলভূমি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ভোটাধিকার পেলেও শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী। জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন না থাকায় রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের বাইরেই থেকে যাচ্ছে তাদের একটি বড় অংশ। নদীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করায় তাদের সঠিক জনসংখ্যাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

    মানতা সম্প্রদায়ের সদস্য শিরিনা জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের নদীতে ছোট ছোট নৌকাতেই তাদের পুরো জীবন কেটে যায়। শিক্ষা ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী জীবিকার তাগিদে নদী কিংবা সাগরে মাছ ধরতে ছুটে বেড়ায়। আধুনিক সভ্যতার যুগে থেকেও আধুনিকতার স্পর্শ তাদের জীবনে প্রায় অনুপস্থিত। নদীতেই জন্ম, নদীতে বেড়ে ওঠা, নদীতেই মৃত্যু—এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার করছে তারা। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া সুইচগেট এলাকায় এমনই এক মানতা গোষ্ঠীর দেখা মিলেছে।

    স্থানীয় মো. আলী জিন্নাহ বলেন, আমারা যুগযুগ ধরে এদেরকে নৌকায় ভাসমান জীবন-যাপন করে আসছে দেখে আসছি। শিক্ষা, চিকিৎসা, সরকারি সহায়তা ও নাগরিক পরিচয়ের অভাব তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফলে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তালিকায় রয়েছে মানতা সম্প্রদায়। শিশুদের স্কুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পেটের দায়ে পড়াশোনাকে তারা অনর্থক মনে করে। বয়স দশ-বারো হলেই অনেক শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গে মাছ ধরায় যুক্ত হয়ে পড়ে। না হলে প্রতিদিনের খাবার জোটে না। দক্ষিণাঞ্চলের নদী ও মোহনাগুলোতে ভেসে বেড়ানোই তাদের নিয়তি।

    রাষ্ট্র যেখানে ভালো ফলাফলের প্রজন্ম নিয়ে গর্ব করে, সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত—এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মানতা সম্প্রদায়ের সদস্যরা। তাদের ভাষ্য, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তারা এখনো উপেক্ষিত।
    তিনি তাদেরকে মূলধারার জীবন-যাপনে নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

    এ বিষয়ে গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, “মানতা সম্প্রদায় জলজ ও ভাসমান জনগোষ্ঠী। তাদের শিশুদের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় আনা কঠিন। তবে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাদের আবাসস্থলের নিকটবর্তী কোনো স্থানে উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে তারা অন্তত জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারবে।”

    নদীর সঙ্গে আজন্ম প্রেম, নদীর সঙ্গেই বেঁচে থাকার লড়াই মানতা সম্প্রদায়ের। আগত ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রতিনিয়ত তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। মৃত্যুভয়, আতঙ্ক আর সংগ্রামের এই জীবনে তারা ক্লান্ত। তবুও সুযোগ পেলে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো ডাঙায় বসবাস করতে চায় তারা—আর শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চায় মানতা সম্প্রদায়ের প্রতিটি শিশুকে।

     

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    বরগুনায় জমি দখল করবে না বলে পুলিশকে মুচলেকা, অতঃপর কৃষকের ধান লুট

    বরগুনা পুলিশ সুপারকে জমি দখল করবে না বলে লিখিত মুচলেকা দেওয়ার পরও আমতলীতে এক কৃষকের জমির ধান কেটে নিয়ে...