More

    প্রকৃতির ডাকে বড়শি হাতে, সাইফুলের মাছ ধরা নেহাতই শখ

    অবশ্যই পরুন

    সুমন দেবনাথ, বানারীপাড়া(বরিশাল) প্রতিনিধি :  মৎস্য মারিব, খাইব সুখে’- সুখী ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ প্রাচীন বাংলার লোকমুখে বহুল প্রচলিত প্রবাদ। বাঙালি ও মাছ তাই একে অন্যের পরিপূরক। মাছ নিয়ে বাঙালির মনের কোণে আছে তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। একজন বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মাছ তাকে কাছে টেনে নেবেই।

    তাই তো ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ যেন বাঙালি জীবনের ঐতিহ্য বহন করে। এ প্রবাদ কমবেশি সকলেরই জানা। নদীমাতৃক এদেশে ছড়া, খাল, বিল, নদী, সমূদ্র, দিঘি, পুকুর, ডোবা সবখানে এক সময় মাছ পাওয়া যেত। গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ বাঙালির ঐতিহ্য। বাঙালিরা ঝাঁকি জাল, চাই, ডুক, পলই ইত্যাদি দেশীয় মাছ ধরার উপকরণ ব্যবহার করতো। অধিকাংশ লোক বাজার থেকে মাছ না কিনে খাল-বিল, দিঘি, পুকুর ডোবা ইত্যাদিতে ঝাঁকিজাল ব্যবহার করে মাছ ধরে টাটকা মাছ খেতে পারতো।

    বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে মাছ ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছরের পুরানো এই শিল্পটি আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি একটি শিল্প, একটি বিজ্ঞান এবং অনেকের জন্য একটি আনন্দময় বিনোদনের মাধ্যম।

    বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশ বড়শি দিয়ে মাছ ধরার পদ্ধতি ব্যবহার করে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যা মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন চক্রে তেমন কোনো ক্ষতি করে না।

    প্রকৃতির ডাকে বড়শি হাতে শখের বসে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামের একটি দীঘিতে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলো ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করা প্রাক্তন ছাত্র মোঃ সাইফুল ইসলাম। পুকুর(দীঘি) থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে তার বাসা। সাইফুল আর তার প্রতিবেশী এক ভাই যিনি বর্তমানে বরিশাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোঃ ইমরান আহমেদ মিলে দুজনে একসাথে চলে যায় মাছ শিকার করতে।

    এরপর একটি জায়গায় বসে বড়শিতে গাঁথার জন্য মাছের খাবারের টোপটি তৈরি করে নিলো। এরপর বড়শিটি পুকুরের জলে ছুড়ে মারলো আর অপেক্ষা করতে থাকলো বড়শিতে কখন মাছ ধরে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেল কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত কোন মাছ বড়শিতে ধরা না পরায় মনটা খুবই খারাপ হয়ে যেতে লাগ তাদের। এদিকে মাথার উপরে সূর্যের তাপ মনে হচ্ছিল মাছ শিকার করা ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসে কিন্তু সাইফুল আগেই বলেছিলো মাছ ধরতে খুবই ভালো লাগে তার মাছ ধরা একটি নেশা। মাঝে মাঝে একটু জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো তারা দুজনে।

    মাছ শিকার বাঙালী জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামাঞ্চলে মৌসুমি জলাশয় বা বিলে নানা সরঞ্জাম দিয়ে বা সরঞ্জাম ছাড়া প্রায়ই মাছ ধরা একটু সুপরিচিত দৃশ্য। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে মাছকে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম টোপ দিয়ে আকৃষ্ট করা হয় অথবা চারা ফেলে প্রলুব্ধ করা হয়। বড়শিতে মাছ ধরার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ওকিনাওয়া আইল্যান্ডের সাকিতারি গুহায় আজ থেকে ২৩ হাজার বছর আগে মাছ ধরার বড়শি পাওয়া যায়। পূর্ব তিমুরের জেরিমাইয়ের গুহাতেও বড়শির আকৃতিতে ফাঁদ পাওয়া যায়। তা ছাড়া মেক্সিকোর পশ্চিম উপকূলে সিড্রোস দ্বীপে ১১০০০ খ্রিস্টপূর্বে আমেরিকায় বড়শি পাওয়া যায়। বড়শিতে কিন্তু সারা বছরই মাছ ধরে না। মাছ ধরার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল।

    একটানা চার-পাঁচ দিন বৃষ্টির পর সব জলাশয়ে পানি থই থই করে। তখন পুঁটি মাছের প্রজনন সময় হওয়ায় শরীরে লাল দাগ হয়, গ্রামে এটাকে বলা হয় ‘পুঁটি মাছ বিয়ার শাড়ি পরছে’। বড়শির টোপে জড়িয়ে আছে অনেকের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া।

    বড়শিতে চলে ওদের সংসার। বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নদী-খাল ভরাট হয়ে মিঠা পানির মাছ কমে যাওয়া আর গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীতে কেবল কাজের ধরন পাল্টে গেলেও বড়শিতেই বাঁধা বানারীপাড়ার শতাধিক পরিবারের কয়েক’শ’ জীবন। নগরায়ন, বাড়িঘর, দোকানপাট সৃষ্টির আধিক্যের কারণে দেশের বহু পুকুর, দিঘি, ডোবা, ঝিল, হাওর ইত্যাদি ভরাট হয়ে গেছে দেশে পুকুর, ডোবা ভরাটের কারণে মাছ ধরার কাজে ব্যাপক হারে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা ও বর্তমানে অনেক খানি কমে গেছে। জলাশয়ে ছিপ ফেলে বড়শি দিয়ে আঁধার গেঁথে মাছ ধরাটা গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্য।

    কিন্তু কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যাবার পথে। হঠাৎ কোন হ্যাচকা টানের শব্দ কিংবা নিরব শিকারী বড়শি হাতে পুকুর-খাল ও বাড়ির পাশের পতিত জলাশয়ের পাশে চুপচাপ বসে আছে ছিপ কেঁপে ওঠার আশায়, গ্রাম বাংলার মেঠোপথের ধারে এমন চিত্র আগে মিলতো হর-হামেশাই। ডুবা কেঁপে উঠলেই আচমকা বড়শিতে টান দেয়, তখন হয়তো উঠে আসে বাহারী কোন রুপালী রঙের মাছ। শৌখিন মৎস্য শিকারী মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমার বড়শিতে একটি মাছ ধরা পরলো। খুব ভালো লাগছিল আবার ভয় ও করছে কারণ বড়শিটি উঁচু করতেই দেখতে পেলাম মাঝারি সাইজের একটি পাঙ্গাস ধরা পড়ে।

    আমি মাছটি দেখতে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়ে পড়ে আমার সাথে আমার ভাই ইমরানও আনন্দে চিৎকার করে ওঠে অপেক্ষার ফল আমরা পেলাম। যাইহোক মাছটিকে নিজের আয়ত্তে এনে একটি এসি জালের সাহায্য মাছটিকে জল থেকে উপরে উঠালাম।

    তিনি আরও জানান মাছটিকে উপরে উঠিয়ে তার মুখ থেকে বড়শিটি খুলে নিলাম। মাছটি খুবই ছটফট করছিল তাই মাথার উপর আঘাত করে মাছটিকে দুর্বল করে ফেললাম। নিজের বড়শিতে মাছ ধরেছে এটি যে কতটা আনন্দের তা বলে বোঝানো যাবেনা। যাইহোক বহুল প্রত্যাশিত মাছটির সাথে কিছু ছবি তুললাম এবং শিকার করা মাছটি নিয়ে বাড়িতে রওনা হলাম।

    বরিশাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন বড়শি দিয়ে মাছ ধরা অনেক ধৈর্যের বিষয়। কারণ বরশি ফেলে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। মাছ কখন উঠবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার চিত্র এখন আর তেমন দেখা যায় না। এক সময় বড়শি দিয়ে মাছ ধরার চিত্র ছিল গ্রাম বাংলার প্রতিদিনের রুপ । কিন্তু কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যাবার পথে।

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    পিরোজপুরে যুবদল নেতার উদ্যোগে বেহাল সেতু মেরামত

    পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় যুবদল নেতার উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে ১১৪ ফুট দীর্ঘ একটি বেহাল সেতু মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। উপজেলার...