পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর সাইনবোর্ড, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এক বিশাল সবুজ প্রহরী। যেটা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙন থেকে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাঙ্গাবালী জনপদকে রক্ষার প্রাকৃতিক বর্ম। সেই সংরক্ষিত বনেই এখন রাতের আঁধারে চলছে ভারী যন্ত্রের দাপট। তরমুজ চাষের প্রস্তুতি হিসেবে বনের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে মাটির বাঁধ, উপড়ে ফেলা হচ্ছে শত শত ম্যানগ্রোভ গাছ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলায় কাজ থেমে থাকলেও রাত নামলেই এক্সকাভেটর ঢুকে পড়ে বনে। গাছ কাটা, মাটি তোলা সবই চলে অন্ধকারে। বন বিভাগ বলছে, প্রাকৃতিক বনের এই অংশ পুরোপুরি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পড়লেও জমির মালিকানা নিয়ে রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন আর বন বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের মাঝেই সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়েছে উপকূলের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, চর সাইনবোর্ডের ম্যানগ্রোভ বেল্ট উপকূলীয় জনপদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বেল্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাঙ্গাবালীসহ আশপাশের এলাকার ওপর ঝুঁকি আরো বাড়বে।
রাতে বুলডোজারের গর্জন
স্থানীয়রা জানান, ১৮ নভেম্বর ঠিক মধ্যরাতে দুইটি এক্সকাভেটর মেশিন ঢুকে পড়ে সংরক্ষিত বনের ভেতর। শুরু হয় মাটি তোলা, বাঁধ কাটা, গাছ উপড়ে ফেলা। পরদিন যোগ হয় আরো একটি মেশিন।
তিনটি বুলডোজারের রাতভর ‘অপারেশনের’ চিহ্ন সকালে সূর্যের আলোয় স্পষ্ট হয়। দেখা যায় শতাধিক ঝাউ, কেওড়া, গেওড়া, বাইনগাছ কাটা কিংবা উল্টে রাখা। কোথাও মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে শেকড়, কোথাও পড়ে থাকা বিশাল গুঁড়ি সাক্ষ্য দিচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞের। দিনের বেলায় সংরক্ষিত এই বনে বন্ধ থাকে ধ্বংসযজ্ঞ।
মানুষ নেই, আছে মেশিন, তাও বন্ধ। কিন্তু রাত নামলেই ফের শুরু হয় বন ধ্বংস। স্থানীয়রা জানান, রাতেই সব হয়, দিনে কেউ এদের ধরে না।
সংরক্ষিত বনে তরমুজ চাষ
২০১০ সালের ৪ এপ্রিল চর সাইনবোর্ডকে ৪১৫ একর সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে সরকার। পরের বছরে জেগে ওঠা পরিত্যক্ত চরগুলোও বন বিভাগের আওতায় এনে গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর ২০ হেক্টরে ঝাউবাগান, ১০ হেক্টরে করমজা, ৩০ হেক্টরে কেওড়া, গেওড়া, বাইন বনায়ন করা হয়। এখন তরমুজ চাষ করতে সেই গাছগুলো ধ্বংস করছে দখলদাররা।
উপকূলীয় বন বিভাগের কাউখালী বিট কর্মকর্তা মো. জালাল আহমেদ খান বলেন, এটা পুরোপুরি সংরক্ষিত বন। আমরা এক্সকাভেটরের কাজ বন্ধ করেছি। ইউএনও স্যারকে জানিয়েছি।
রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের ভাষ্য, কাগজপত্র দিয়ে এসেছি। রাতে ফের আরো একটি এক্সকাভেটর যুক্ত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বন বিভাগের লোক নামলে কাজ থামে, তারা ফিরে গেলে আবার বন ধ্বংস শুরু হয়।
ভূমি অফিসের ‘মৌখিক অনুমতি’
তরমুজ খেতের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে উঠে আসছে স্থানীয় মানিক মোল্লার নাম। তিনি জানান, সংরক্ষিত বনে তরমুজ চাষের জন্য তহসিলদার অনুমতি দিয়েছেন।
কিন্তু তহসিলদার জাহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, “ইউএনও স্যার সবকিছু জানেন।”
রাঙ্গাবালীর ইউএনও রাজীব দাস পুরকায়স্থ বন নিধনের কথা জানার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আগে জানতাম না। বন বিভাগ কাগজ দিয়েছে, ব্যবস্থা নেব।
উপকূলীয় পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বহু বছর ধরে এই অঞ্চলে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এই ম্যানগ্রোভ বেল্ট ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঢাল। নদীভাঙন রোধ করে চর ভূমিকে টিকিয়ে রাখে। এই বন উজাড় হলে রাঙ্গাবালীসহ আশপাশ পুরো অঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
আরিফুর রহমান আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, সংরক্ষিত বনের ওপর তরমুজের একচেটিয়া দখল মানে উপকূলকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া।
