More

    ” মাটির সাথে কৃষকের মেলবন্ধন ” – বাঙালির ঐতিহ্য “‘নবান্ন উৎসব “

    অবশ্যই পরুন

    সুমন দেবনাথ, বানারীপাড়া(বরিশাল) প্রতিনিধি : ‘নবান’ শব্দটি এসেছে বাংলা দুটি শব্দ থেকে ‘নব’ এবং ‘অন্ন’। ‘নব’ অর্থ হলো নতুন, আর ‘অন্ন’ অর্থ হলো খাদ্য বা ভাত। অর্থাৎ, নতুন ধান থেকে তৈরি হওয়া চাল দিয়ে প্রথম যে ভাত রান্না করা হয়, সেই উপলক্ষ্যে এ উৎসবটি পালিত হয়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, এটি কৃষকদের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলার আনন্দ, কৃতজ্ঞতা এবং নতুন করে বাঁচার এক দারুণ অনুভূতি। এটি মূলত আমাদের গ্রাম-বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী অনেক পুরোনো উৎসব।

    শরৎকাল শেষ হতে চলেছে, চারপাশে হিমেল হাওয়া বইছে। মাঠের দিকে তাকালেই দেখা যায় এক অপরূপ দৃশ্য, মাঠজুড়ে সোনালি রঙের ধানের শীষ বাতাসে দুলছে। এ সময় কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে এক আনন্দের হাসি। কারণ, বছরের পর বছর ধরে যে ফসল ফলানোর জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করেছে, সেই ফসল ঘরে তোলার সময় হয়েছে। এ সময়ই পালিত হয় আমাদের সবার প্রিয় নবান্ন উৎসব। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ নিয়ে হেমন্ত ঋতু। একসময় কার্তিকে গ্রামাঞ্চলে মানুষের মধ্যে দুর্ভিক্ষ নামতো।

    যার নাম ছিল ‘মঙ্গা কার্তিক’। তাই কবে কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে, সে প্রতীক্ষায় প্রান্তিক মানুষের জীবন কাটত। মুখে নতুন অন্ন জোগানোর অতি আগ্রহ নিয়ে রাতদিন কাটত পরিবারের সবার। কার্তিকের শেষ দিকে ও অগ্রহায়ণের শুরুতেই শুরু হয়েছে আমন সোনালি ধান কাটা, আবার কেউবা ঘরে তুলছেন আগাম ধান। তবে মরা কার্তিক দূর হলেও এরই সঙ্গে দূর হচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতির নবান্ন উৎসবের আমেজও। গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ও সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন। পহেলা অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন, অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’।

    অনেকে এটিকে ‘আঘন’ মাস বলে থাকেন। গ্রামবাংলায় নানি-দাদিরা এ মাসকে আঘন মাস বা ধান কাটার মাস বলেন। এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে ঐতিহ্যবাহী এবং অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও আকাশ সংস্কৃতির হাল আমলে অনেকটাই পাল্টে গেছে অগ্রহায়ণের চিরাচরিত সেই উৎসবের রীতি। যেন ভুলতে বসেছে আধুনিকমনস্ক কৃষক সমাজও। তথাপি কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার সরল জীবনযাপনের প্রতীক এই নবান্ন উৎসব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাঙালির জীবন থেকে। নবান্ন উৎসব সব দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

    প্রান্তিক কিষান-কিষানির হাসিকান্নার অবসান ঘটিয়ে অগ্রহায়ণের নতুন আমন ধান ঘরে ওঠানোর কাজের মাঝে খুঁজে পায় অপার আনন্দ। গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মবর্ণনির্বিশেষে নবান্ন কেন্দ্র করে বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠে। এ উৎসব ঘিরে সনাতনী সম্প্রদায়ের আছে নানা রকম লৌকিক পার্বণবিধি। নতুন অন্ন নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী জলে-স্থলে ও কাককে পিতৃপুরুষের বিগত আত্মার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা নবান্নের একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা।

    সনাতন ধর্মের সংস্কারমতে অন্নের আরেক নাম প্রাণ, প্রাণের যজ্ঞই প্রকৃতপক্ষে বিগত আত্মার প্রতি নিবেদন। নবান্ন উপলক্ষে আগের দিন রাতে প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় আতপ চালের গুঁড়া গুলিয়ে আলপনা আঁকা হতো। মুসলিমরা নতুন ধান কেটে বউ, মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের দাওয়াত করে আনত। তাদের নিয়েই চলত পিঠা উৎসব। নতুন চাল ঢেঁকি দিয়ে গুঁড়া করে তৈরি করা হতো হরেকরকম পিঠাÑ ভাপা, চিতই, দুধপুলি, পিঠাপুলি, পায়েস, সেমাই, ক্ষীর, খই, মুড়ি আরও কত কি! শীতের আগমনিতে খেজুর রস দিয়ে তৈরি হতো এসব সুস্বাদু পিঠা। নবান্ন উৎসবের দিনটি শুরু হয় এক অন্যরকম উদ্দীপনা নিয়ে। পরিবারের সবাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নতুন পোশাকে সেজে ওঠে।

    বাড়ির চারপাশে নতুন ধানের গোছা দিয়ে তোরণ বা ছোট ছোট ঘর সাজানো হয়। এই দিন মা-বোনেরা নানা ধরনের পিঠা বানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নতুন ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা এবং দুধপুলির মতো মজাদার সব পিঠা। এ পিঠাগুলো শুধু পরিবারের মধ্যেই খাওয়া হয় না, প্রতিবেশীদের বাড়িতেও দেওয়া হয়।

    নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। এ উৎসবের একটি সুন্দর দিক হলো সবাই মিলেমিশে আনন্দ করা। এ দিনে অনেক গ্রামে লোকনৃত্য, গান আর বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এটি মূলত সবার সঙ্গে ভালোবাসা আর আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটি দারুণ সুযোগ। নবান্ন উৎসব আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এটি আমাদের শেখায় পরিশ্রম করলে তার ফল অবশ্যই পাওয়া যায়।

    কৃষক কত কষ্ট করে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলায় আর সেই ফসল ঘরে তোলার আনন্দ কতটা বড়, তা এ উৎসবের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়। নবান্ন হলো নতুন করে শুরু করার একটি প্রতীক। পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে নতুন ফসল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এক দারুণ বার্তা। আগামী বছর আরও ভালো ফসল হবে, এ প্রত্যাশা নিয়েই পালিত হয় নবান্ন উৎসব। আজকের প্রজন্ম নবান্নকে চেনে গল্পে, সিনেমায়, অথবা পাঠ্যবইয়ের পাতায়। মাঠে নতুন ধান ওঠে ঠিকই, কিন্তু নেই সেই প্রাণচাঞ্চল্য অপেক্ষার উত্তেজনা। আধুনিকতার ছোঁয়া, ব্যস্ততার চাপ আর ধর্মীয় কিছু ব্যাখ্যার কারণে নবান্নের অনুষ্ঠান আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কালের বিবর্তনে।

    অগ্রহায়ণ এলেই একসময় গ্রামবাংলা জুড়ে পিঠা-পায়েসের ঘ্রাণ, আত্মীয়-স্বজনের সমাগম, আর নতুন ধানের ভাত রান্নার ধুম পড়ে যেত। তা এখন সব কল্পনায়। সবকিছু ধীরে ধীরে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির পাতায়। সুমন দেবনাথ

    সম্পর্কিত সংবাদ

    সর্বশেষ সংবাদ

    সরকার সেবার মান বাড়াতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে : বরিশাল জেলা প্রশাসক

    রাহাদ সুমন, বিশেষ প্রতিনিধি: বরিশালের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. খায়রুল আলম সুমন বলেছেন-সরকার প্রতিটি উপজেলায় সেবার মান...