দেশীয় প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা ব্যায়ে বিএডিসি বরিশালের ২৮ উপজেলার সাড়ে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে ৬৬ হাজার টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বাস্তাবায়নাধীন প্রকল্পটির ভৌত অবকাঠামোর প্রায় ৭০ ভাগ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে ২০২৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এর মেয়াদ আরো অন্তত একবছর বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।
প্রকল্পটির জন্য গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা ব্যায়ের পরে চলতি অর্থ বছরে আরো ১১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যারমধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রকল্পটির জন্য ব্যায়ের পরিমান প্রায় ২৫৫ কোটিতে দাঁড়াচ্ছে। ভৌত অগ্রগতির হার প্রায় ৬৫ ভাগ বলে বিএডিসির প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাবহার হ্রাস করে ভূ-উপরিস্থিত পানির ব্যবহার বর্তমানের ১ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর থেকে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টরে উন্নীত হবে। পাশাপাশি সৌরচালিত লো-লিফট পাম্পের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে পুন:খননকৃত খাল ও পুকুর সহ ফসল রক্ষা বাঁধে বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করনে সহায়তা করবে। ফলে ভূ-উপরিস্থিত পানির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন হ্রাসের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাবার প্রবনতা কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে বিএডিসি’র দায়িত্বশীল মহল। প্রায় ১২ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে সেচযোগ্য জমির অর্ধেক এখনো সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে ২ লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সেচাবাদ হলেও তারমধ্যে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসি’র অবদান ২০ হাজার হেক্টরেরও কম। উপরন্তু গত রবি মৌসুমে এ অঞ্চলের মাঠে ব্যবহৃত বিভিন্ন মাপের ১৯,৪৩৮টি সেচ পাম্পের মধ্যে বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের সংখ্যা ছিল মাত্র ১,৪৬২টি বা ৭.৫১%। ডিজেল চালিত পাম্প ১৭,৯৫৮ বা ৯২.৩০%। আর সোলার চালিত পাম্প ছিল ৩৭টি বা ০.১৯ভাগ। এমনকি সরকার ২০০২-০৩ সাল থেকে কৃষিসেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতে ২০% ভর্তুকি প্রদান করলেও অধিক ব্যায়বহুল ডিজেলচালিত পাম্পে কোন ভর্তুকি নেই। অথচ বরিশাল অঞ্চলে সেচকাজে ব্যবহৃত ৯৩ ভাগ সেচ যন্ত্রই ব্যায়বহুল ডিজেলচালিত।
ফলে এ অঞ্চলে অত্যাধিক সেচ ব্যায়ের কারণে ধানের উৎপাদন ব্যায়ও দেশের যেকোন স্থানের তুলনায় বেশী। ফলে একদিকে রবি মৌসুমে সেচাবাদে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে না, অপরদিকে অধিক ব্যায়বহুল সেচ ব্যায়ের কারণে তাদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হচ্ছে না। অথচ সেচযন্ত্রের অর্ধেকও বিদ্যুতায়িত করতে পারলে এ অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন বর্তমানের প্রায় ৫০ লাখ টনের স্থলে অন্তত ৬০ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
এমনকি কৃষিসেচ ব্যবস্থা বিদ্যুতায়িত করতে পারলে লাগাতার লোকাসানে থাকা এ অঞ্চলের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোও আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারতো বলে মনে করছেন জ¦ালানী বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় আহুত ‘ট্রান্সফর্মিং বাংলাদেশ এগ্রিকালচার আউটলুক ২০২৫’ শির্ষক এক কর্মশালায়, ‘বরিশাল কৃষি অঞ্চলে সেচযোগ্য জমির পরিমান ৬ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৪ হেক্টর বলে জানিয়ে এরমধ্যে মাত্র ২ লাখ ২৫ হাজার ৪৩ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ অঞ্চলে সেচের আওতায় আনা জমির পরিমান এখনো মাত্র ৩৫.৭৫ ভাগ বলে ঐ কর্মশালায় উপস্থাপন করে বোরো মৌসুমেই আবাদযোগ্য অনাবাদি জমির পরিমান ৯৮ হাজার ৩৭৫ হেক্টর বলে জানান হয়েছে। এসব বিবেচনায় বিএডিসি ২০২৩-২৪ অর্থ বছর থেকে ‘বরিশাল অঞ্চলে সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎচালিত ২৫০টি, ১ ও ২ কিউসেক সেচযন্ত্র, ২০টি ১কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন সোলার লো-লিফট পাম্প, ৩২৫ কিলোমিটার ছোট সেচ খাল ও ৫০ কিলোমিটার বড় সেচখাল পুন:খনন এবং প্রতি কিলোমিটারে ৪টি করে বিভিন্ন খালের পাড়ে প্রায় দেড় হাজার পানি নির্গমন স্থাপনা নির্মান করা হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় ২শটি পাম্প হাউজ ও ৩শটি ওয়াটার পাস নির্মান করা হচ্ছে।
একই সাথে প্রায় ৪ হাজার ঘনমিটার করে ৩০টি পুকুর পুন:খননও ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সেসব পুকুর থেকে বিভিন্ন জমিতে সেচ প্রদানও সম্ভব হবে। একইসাথে প্রকল্পটির আওতায় ২৭০টি ১ ও ২ কিউেসেক ক্ষমতার ভূ-গর্ভস্থ সেচনালাও খনন করা হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় ৪০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধও নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় ফলের বাগানের জন্য ৭৫টি ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেম ও ৪০টি ভূ-গর্ভস্থ নিষ্কাশন নালা নির্মিত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প এলাকার খালগুরোতে পানি ধরে রাখতে ২০৩ ভিন্টের ৩০টি রেগুলেটর’ও নির্মান করা হচ্ছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ১৬,৫০৪ হেক্টর জমিতে বাড়তি সেচ সুবিধা নিশ্চিতের মাধ্যমে ৬৬ হাজার ১৪ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হবে বলে আশা করছে বিএডিসি’র দায়িত্বশীল মহল।
একইসাথে ফলের বাগানেও সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়বে বলেও আশাবাদী কৃষিবীদ সহ বিএডিসি। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ ওয়াহিদ মুরাদ জানান, আমরা প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে প্রকল্পটি বাস্তাবায়নের চেষ্টা করছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃষি প্রধান বরিশাল অঞ্চলে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
